মানিকদা- সবার কাছে শুনে শুনে গুলজারও তাঁকে এই নামটাতেই ডাকতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' হিন্দিতে করতে চাইছেন সত্যজিৎ। সেই সিনেমার স্ক্রিপ্ট আর গান নিয়েই গুলজারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। গুলজারের ভাষায়, '' প্রথমেই দেখলাম, ওঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা গুগাবাবা'র বাঙালি ফ্লেভারটা হিন্দিতে করতে গিয়ে যেন নষ্ট না হয়। আমার এত ভাল লেগেছিল ব্যাপারটা, যে একজন বিশ্ব-পরিচিত পরিচালক তাঁর মাতৃভাষার বিশেষত্ব ও মাধুর্ষের ব্যাপারে কোনও 'অ্যাডজাস্টমেন্ট' করতে রাজি নন। আমায় বললেন, 'তুমি গুপী গাইন দেখেছ?' আমি বললাম, 'হ্যাঁ, দেখেছি।' ' আচ্ছা বলো তো, 'সাধাসিধা মাটির মানুষ' এই কথাটা কী ভাবে অনুবাদ করবে ?' আমার মাথায় তখুনি যা এল বললাম, ' সাধাসিধাকে খুব পালটানোর তো দরকার নেই, ও রকমই রাখা যেতে পারে।' তাতে উনি খুব আশ্বস্ত হলেন, ফের দুটো জলদগম্ভীর, 'Good, good.'
advertisement
কলকাতায় ফিরে এলেন গুলজার। সত্যজিতের সঙ্গে চিত্রনাট্য নিয়ে বিস্তারিত কথা হল। ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্টকে বললেন স্ক্রিপ্টটা নিয়ে আসতে। তার পর সেটা দেখে গানগুলো নিজে হাতে লিখে দিলেন। মুগ্ধ গুলজার, '' উনি তখন বিশ্ববিশ্যাত। বললেই হয়তো তখুনি কেউ লিখে দিত। কিন্তু বোধহয় নির্ভুল রাখতেই লিখে দিলেন। একজন মানুষ তাঁর কাজ সম্পর্কে কতটা সিরিয়াস হতে পারেন, ওঁকে দেখে আবারও সেই শিক্ষাটা নিলাম। তাঁর হাতে লেখা সেই কাগজগুলো এখনও আমার কাছে অমূল্য স্মারক হিসেবে রয়ে গিয়েছে।''
গুপী গাইন হিন্দিতে হল না। সত্যজিতের সঙ্গে গুলজারের প্রথম কাজ করার সুযোগ মার গেল। কিন্তু সম্পর্কটা রয়ে গেল। গুলজারের ভাষায়, '' আমি নিউ থিয়েটার্স-এ প্রায়ই যেতাম। তনুদা, মানে তরুণ মজুমদারের সঙ্গে কাজ করতাম। তখন দোতলায় মানিকদার এডিটিং রুমে গিয়ে দেখা করে আসতাম। এক বার নিউ থিয়েটার্সে গেছি, দেখি, শশী কাপুর, মানিকদা, আরও কয়েকজন কথা বলছেন। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক টুকরো সেই কথাবার্তা এখনও মনে গেঁথে আছে। উনি এ-রকমই একটা কিছু বলছিলেন, if we dont have money to spend on it, we have to spend our brain. কথাটা আমায় নাড়িয়ে দিয়েছিল। অজুহাত না খাড়া করে, নিজেকে আরও বেশি প্রয়োগ করতে হবে, এই শিক্ষাটা ওই বাক্য থেকে নিলাম।
দ্বিতীয়বার সত্যজিত রায়ের সঙ্গে কাজের সুযোগ এল গুলজারের। 'পথের পাঁচালী' সিনেমার অপুর মা সর্বজয়া ওরফে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রফেসর শঙ্কুর গল্প নিয়ে দিল্লি দূরদর্শনে হিন্দিতে সিরিয়াল করতে চাইলেন। গুলজারকে দেওয়া হল চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব। ফাইনাল স্ক্রিপ্ট পাস করবেন সত্যজিৎ, আদা-জল খেয়ে লেগে পড়লেন গুলজার। কিন্তু কিছুদিন পর খবর পেলেন, সিরিয়ালটি হবে না। সেবার দমে গিয়েছিলেন গুলজার, দ্বিতীয়বারও 'মানিকদার' সঙ্গে কাজ করা হল না!
তৃতীয়বার নিজেই ছুটে গেলেন গুলজার। খবর পেলেন 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি' করবেন সত্যজিৎ। হোটেলে গিয়ে গুলজার শোনেন, কলকাতা ফিরবেন বলে এয়ারপোর্ট বেরিয়ে গিয়েছেন। ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে ছুটলেন গুলজার। সোজা সত্যজিতের সামনে, '' মানিকদা, আমি শতরঞ্জ কে খিলাড়িতে কাজ করতে চাই। স্ক্রিপ্ট লিখব।' কিন্তু ততদিনে চিত্রনাট্য লেখার কাজ অন্য কাউকে দিয়ে ফেলেছেন সত্যজিৎ! গুলজার বলেন, '' একটা কষ্ট মনকে আচ্ছন্ন করে রাখল বহু দিন। এমনকী এখনও। আমার আর মানিকদার সঙ্গে কাজ করা হয়নি।''
তথ্যঋণ-- পান্তাভাতে, গুলজার