জন প্রতিনিধি হিসেবে ভাতা পান যৎসামান্য। তাই সংসার চালাতে নিয়ম করে বসে পড়েন সবজি বিক্রি করতে। সেই ছোট বয়সে বাবার সঙ্গে পা রেখেছিলেন দুর্গাপুরে। শুরু করেছিলেন ভাড়া বাড়িতে বসবাস। এখনও সেখানেই থাকেন তিনি। ২৫ বছর রাজনীতি করার পর, তিনি ২০১৭ সালে পান কাউন্সিলর হওয়ার টিকিট। শাসক দলের প্রতীকে জয়লাভ করে তিনি। তারপর জন পরিষেবার কাজে হাত লাগান। তবে এখনও প্রতিদিন সকালে তিনি সবজি বিক্রি করেন দুর্গাপুর সেন মার্কেটে।কাটান বৈভবহীন জীবন। দুটি ভিন্নধর্মী কাজ একা হাতে প্রতিদিন সামাল দেন তিনি। ঘুম থেকে উঠে যান ভোর তিনটের সময়। তারপর রাত পর্যন্ত চলে পরিশ্রম।
শিপুল সাহা। দুর্গাপুর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার। তিনি এখন চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ তার বৈভবহীন জীবনযাপন। এখনও পর্যন্ত থাকেন ভাড়া বাড়িতে। প্রতিদিন সকালে নিয়মিত করেন সবজি বিক্রি। আর এত কিছুর পরেও গুরুত্ব সহকারে সামলে যান নিজের দায়িত্ব। স্থানীয়দের সুবিধা-অসুবিধা মেটাতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তিনি। প্রতিদিন স্থানীয় বাসিন্দাদের অসুবিধা মেটাতে কার্যালয় সময় কাটান দীর্ঘক্ষণ নিজের এলাকায়। আবার দলীয় কাজকর্ম সামাল দেন একা হাতে। উন্নয়নের জন্য নিয়মিত যাতায়াত করেন দুর্গাপুর পুরসভার কার্যালয়ে। একই সঙ্গে সামাল দেন ব্লক সভাপতির দায়িত্ব। আর সকাল থেকে তাকে পাওয়া যায় সবজি বাজারে। সেখানে তিনি অন্যান্য বিক্রেতাদের মতই হাঁকডাক করে করেন সবজি বিক্রি।
আট বছর বয়স থেকেই জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছেন শিপলু সাহা। আট বছর বয়সে তিনি হাবরা স্টেশনে শশা বিক্রি করতেন। শিপলু বাবুর বাবা জহর সাহা, দুর্গাপুরে আসেন ১৯৮৪ সালে। দুর্গাপুর ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের শ্রমিকনগরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন। দুর্গাপুর স্টেশন সংলগ্ন ফুটপাতে ফল বিক্রি করতেন তিনি। আর ১৯৯৫ সাল থেকে সবজি বিক্রির পেশা শুরু করেন শিপলু বাবু। তারপর আস্তে আস্তে রাজনীতির হাতে খড়ি হয় তার। তবে রাজনীতির পাশাপাশি দুর্গাপুর সেন মার্কেটে প্রতিদিনই সবজি বিক্রি করতেন তিনি। কাউন্সিলর হওয়ার পরেও সেই পেশা বজায় রেখেছেন কাউন্সিলর। নিজের সংসার চালাতে তিনি এখনও সবজি বিক্রি চালিয়ে যান। তবে তার জন্য জনপরিষেবায় কোনরকম সমস্যা হয় না বলেই জানিয়েছেন শিপুল সাহা।
শিপুল বাবু জানিয়েছেন, যখন তিনি কাউন্সিলর হন, তখন ভাতা পেতেন ৬৭০০ টাকা। যদিও বর্তমানে কাউন্সিলর হিসেবে শিপুল বাবু ভাতা পান ৯৮০০ টাকা। কিন্তু সেই টাকায় চলে না সংসার। সেজন্যই প্রতিদিন সকালে সবজি নিয়ে বসে পড়েন শাসকদলের এই কাউন্সিলর। দুর্গাপুরের অন্যতম পাইকারি সবজি মার্কেট সেনহাটে গলায় গামছা জড়িয়ে সবজি বিক্রি করতে দেখা যায় শিপলু সাহাকে। কাউন্সিলর হয়েও নিজের পুরনো পেশার প্রতি ভালোবাসা রেখে এই কাজ চালিয়ে যান তিনি।
আর্থিক সংগতি পেতে জনপরিষেবার পাশাপাশি তিনি এই কাজ করেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ থেকে শুরু করে ঘর-সংসার সামলানো, সব দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অন্যদিকে কাউন্সিলর হিসেবে এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কাউন্সিলর হিসাবে সবসময়ই সমাদৃত হন স্থানীয়দের কাছে। যদিও সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তিনি এলাকায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন কাউন্সিলর হওয়ার আগেও।কিন্তু দল বদলের দিকে কখনোই যাননি শিপুল বাবু। ১৯৯৮ সাল থেকেই তিনি তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন দলের সক্রিয় কর্মী হিসেবে।
প্রসঙ্গত শিপুল সাহা জন্মগতভাবে উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার বাসিন্দা। বাবা ছিলেন ডাল শস্য মিলের শ্রমিক। আর্থিক অনটনের জেরে জন্মস্থান ছেড়ে দুর্গাপুরে পাড়ি জমান শিপল বাবুর পরিবার। তারপর সেখানেই বড় হয়ে ওঠা। একদিকে সবজি বিক্রি, পাশাপাশি পড়াশোনা দুটোই করেছেন শিপুল সাহা। সবজি বিক্রেতার পাশাপাশি পড়াশোনা করে তিনি মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়েছেন। ঘর-সংসার চালানোর কাজে হাত লাগিয়েছেন। পরবর্তী ক্ষেত্রে তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন পুরো একটি এলাকাকে চালানোর। সেই কাজে শিপলু বাবু সফল বলেই অভিমত প্রকাশ করেন দলের অনেক কর্মী সমর্থক থেকে স্থানীয় বাসিন্দা সকলেই।
এখনও পর্যন্ত ভাড়া বাড়িতেই থাকেন শাসক দলের এই কাউন্সিলর। তবে তার বাবা, স্ত্রী এবং দুই সন্তান থাকেন তার শ্বশুরবাড়িতে। সেখানেই তার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করেন। আর দুর্গাপুরে থেকে ওয়ার্ডের দায়িত্ব সামলে যান সিপুল সাহা। প্রতিদিন ভোর তিনটেই উঠে চলে যান সবজি মার্কেটে। তারপর শুরু হয় ক্রেতা সামলানোর কাজ।
পাশাপাশি এলাকার বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন মেয়র পারিষদদের কাছে। এরপর বিকেলে ফিরে এসে তিনি ফের এলাকা ঘুরে দেখেন, কোথাও কোনও সমস্যা রয়েছে কিনা জানার জন্য। পরে সন্ধ্যের দিকে আবার তাকে পাওয়া যায় দলীয় কার্যালয়ে। রাত পর্যন্ত সেখানে থাকার পর ঘুমোতে চলে যান শাসকদলের এই কাউন্সিলর। পরদিন আবার ভোর তিনটে থেকে শুরু হয় তার দিন। সকাল ন'টা পর্যন্ত শিপুল সাহা একজন সবজি বিক্রেতা। আর সকাল নটার পরে তিনি কাউন্সিলর।