#পশ্চিম বর্ধমান: কুলটির দীর্ঘদিনের সমস্যা হল জলসঙ্কট। প্রায়শই খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায় কিম্বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কুলটিবাসীর জল নিয়ে নিত্যদিনের এই দুর্ভোগ ওঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু উপায় কি? অবরোধ? বিক্ষোভ? ধর্ণা? এগুলো তো স্থায়ী সমাধান নয়। এমনটাই ভেবেছিল কুলটির ডিভিসি কলোনির সদ্য যৌবনে পা রাখা উদ্যমী ছেলে স্বর্ণদীপ চক্রবর্তী এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধু। তাঁরা পড়েছিল গাছ লাগলে বিশ্ব উষ্ণায়ন সহ পরিবেশের বহু সমস্যাই দূরীভূত হয়ে যায়।
সেই সঙ্গে যদি জল সংরক্ষণের মাধ্যমে জলের অপচয় রোধ এবং বৃষ্টির জলের সঠিক ব্যবহার করা যায় তাহলে জলের সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হবে। সমাজের জন্যে গঠনমূলক কিছু করার স্বপ্ন ছিল তাঁদের দু'চোখে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রাতারাতি গত বছর জুন মাসের আঠাশ তারিখে তাঁরা গড়ে তুলল "ডিভিসি ( DVC) কলোনি স্বেচ্ছাসেবক কমিটি"। কমিটির প্রথম কর্মসূচি ছিল সারা শহরে বৃক্ষরোপণ ও জল সংরক্ষণ বিষয়ে এক প্রচার অভিযান। আসানসোল শিল্পাঞ্চলে সাড়া মিলল ভালোই।
তাই তাঁদের কাজের পরিসরও বেড়ে উঠল স্থানীয় মানুষের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায়। কমিটির সভাপতি আসানসোল পুর নিগমের পুর প্রতিনিধি সমাজসেবী দুলাল চক্রবর্তীর নেতৃত্বে নিজেদের পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্বর্ণদীপ চক্রবর্তী,শুভজিৎ মজুমদার, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, তীর্থঙ্কর রায়চৌধুরী, অর্ঘ্যজ্যোতি মন্ডল, ভাস্কর রায়, সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আরও অনেকেই সমাজ সেবার সঙ্গে বর্তমানে নিজেদের ভালোবাসা ও ভালোলাগার বন্ধনে জড়িয়ে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ান। সম্প্রতি ডিভিসি কলোনি লাগোয়া এক বাসিন্দা করোনায় আক্রান্ত হন । সেই সময় এলাকা জীবাণুমুক্তকরণ থেকে যে যুবক আক্রান্ত হয়েছেন সেই পরিবারের পাশে থাকার ব্যাপারেও অঙ্গীকার নিয়েছে এই কমিটি। যেখানে রাজ্যজুড়ে প্রায় প্রতিদিনই করোনা রোগী এবং তাঁদের পরিবারের সঙ্গে অমানবিকতার ছবি প্রকাশ্যে আসছে সেখানে কুলটির এই পাড়া নিসন্দেহে নজির গড়ল।
তাঁরা গত বছর ডিভিসি কলোনি সর্বজনীন দুর্গাপূজা প্রাঙ্গণে প্রায় শতাধিক দরিদ্র শিশুদের নতুন বস্ত্র তুলে দেয়। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষদের সুযোগ সুবিধাগত দিক থেকে যদি উপযুক্ত সহযোগিতা না করা হয় তবে উন্নয়নের পিলসুজের নীচে ক্ষুধার অন্ধকার থেকেই যায়। তাই শুধু বস্ত্র বিতরণে সীমাবদ্ধ না থেকে তারা প্রতি রবিবার কুলটি শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। ইন্দিরা গান্ধী কলোনি, ডিভিসি কলোনি, গাঙ্গুটিয়া, কেন্দুয়া হাই স্কুল সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় দেড়শো থেকে ২০০ দরিদ্র মানুষকে পুষ্টিকর ভোজনেরও ব্যবস্থা করেছে এই স্বেচ্ছাসেবকরা।। শুধু তাই নয় শীতের শুরুতে এই যুবদল প্রায় শতাধিক দুঃস্থ মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে শীত বস্ত্র ও কম্বল।
সম্প্রতি সারা বিশ্ব জুড়ে নেমে এসেছে করোনা নামক মহামারীর প্রবলতর অভিঘাত। মানুষ আজ আতঙ্কিত ও বিপন্ন। সারা দেশ লকডাউনে গৃহবন্দী। দরিদ্র ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে খেটে খাওয়া মানুষ কাজ হারিয়ে আরও দুর্বিষহ দুর্দশার শিকার। এমন অবস্থায় সমাজ সেবার ব্রত গ্রহণকারী এই তরুণ তুর্কীরা ঘরে বসে না থেকে ঝুঁকি নিয়েই রাস্তায় নেমে পড়েছিল। পঞ্চাশের অধিক আসানসোল পুর নিগমের সাফাইকর্মীর হাতে তুলে দিয়েছে চাল ডাল আলু ও পাউরুটির মত বিভিন্ন খাদ্য উপকরণ। এরপর তারা যাত্রীবাহী অটো ও টোটোতে সামাজিক দূরত্ববিধি ও ব্যক্তিগত সুরক্ষার নিয়ম কানুনও সকলকে মেনে চলার আর্জি জানিয়ে "নো মাস্ক নো সীট" নামক প্রচারমূলক কর্মসূচি পালন করে। যাত্রীদের মধ্যে বিতরিত হয় মাস্ক ও সচেতনতামূলক স্টিকার।
এতে দারুন সাড়া মিলেছে। এই কমিটির কার্যাবলী এখানেই থেমে নেই। রয়েছে আরও অভিনব সব পরিকল্পনা। যা স্থানীয় মানুষের অনেক সমস্যার আশু নিরসন করবে বলেই অভিমত শুভঙ্কর রায়, সুব্রত চাঁদ ,অনিমেষ করণজি, সূর্যদীপ চক্রবর্তী, মনোজিৎ মজুমদার, সূর্য ঠাকুর সহ কমিটির অন্যান্য সদস্যদের।
ডিভিসি কলোনি স্বেচ্ছাসেবক কমিটি সমগ্র কুলটিতেই একটি সুপরিচিত নাম। প্রচুর মানুষের নিত্যদিনের আশা আকাঙ্খার অন্যতম ভরসার জায়গা। এটা একেবারেই অরাজনৈতিক একটি মঞ্চ, যেখানে গৃহীত হয়েছে দলমত নির্বিশেষে বহু নাগরিকের পরামর্শ ও উপদেশ। তবে এইসব যুবকদের চলার পথটা মসৃন ছিল না। দরকার ছিল আর্থিক সহায়তা ও প্রশাসনিক সাহায্য। সেইসব ক্ষেত্রে পাড়ার কিছু সহৃদয় মানুষ পাশে ছিলেন। তবে বাহাত্তর নম্বর ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি রিয়া চক্রবর্তী এবং পুর প্রতিনিধি দুলাল চক্রবর্তী এদের মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত করতে সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে অনেক কঠিন কাজই হয়ে গিয়েছে অনেক সহজ। বললেন কমিটির স্বেচ্ছাসেবকরা। কমিটির নবীন সম্পাদক স্বর্ণদীপ চক্রবর্তীর কথায়, 'আমরা চাই আমাদের পাড়ার মত অন্যান্য পাড়াতেও এই ধরনের কমিটি গড়ে উঠুক। যাতে আপদে-বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো লোকের অভাব যেন না হয়'। কমিটির সভাপতি দুলাল চক্রবর্তী বললেন ,' ডিভিসি কলোনির স্বেচ্ছাসেবকরা আমার ওয়ার্ডের সম্পদ। ওদের পাশে আমি সবসময় আছি'। কুলটির এই কমিটির সদস্যরা বয়সে নবীন হলেও তাদের সেবা করার ব্যতিক্রমী চিন্তা ভাবনাকে কুর্ণিশ জানিয়েছেন শহরবাসীও।
VENKATESWAR LAHIRI