#পূর্ব বর্ধমান: ল্যাংচা না-পসন্দ, এমন বাঙালি দূরবীণ দিয়ে খুঁজতে হবে! আর ল্যাংচা মানেই শক্তিগড়! এককথায় ল্যাংচার সাম্রাজ্য! জিটি রোড ধরে আসতে আসতে বেশ খানিকটা আগে থেকেই বোঝা যায় শক্তিগড় আসছে! দূর থেকে ঠাহর করা যায় রাস্তার উপর সারিবাঁধা ল্যাংচার দোকানের বিশাল হোর্ডিং, বড় বড় হরফে লেখা দোকানের নাম! উত্তম কুমারের প্রিয় 'ল্যাংচা মহল' থেকে অমিতাভ বচ্চনের তারিফ করা 'ল্যাংচা কুঠি'! দোকানের বাইরে গাড়ির লম্বা লাইন...ভিতরে ক্রেতাদের গিজগিজে ভিড়! যিনি মিষ্টি ছুঁয়েও দেখেন না, তিনিও শক্তিগড় পেরনোর পথে এক বাক্স ল্যাংচা না কিনে থাকতে পারবেন না-- '' এই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে''!
কিন্তু লোকসভা ভোটের ঠিক আগে শক্তিগড়ের এক অন্য ছবি উঠে এল ! দোকাগুলো মাছি তাড়াচ্ছে, ক্রেতার সংখ্যা হাতে গুনে বলা যায়!
মুখ ব্যাজার করে বসেছিলেন 'ল্যাংচা মহল'-এর দুই কর্ণধার ব্রজ মণ্ডল ও অষ্টম পাল, বললেন, '' ভোটের বাজারে ল্যাংচার বিক্রিবাটা নেই বললেই চলে! ভোটের কারণে গাড়ি তুলে নিয়েছে, নিচ্ছে! চলছে গাড়ি ধরাধরি! কাজেই এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি প্রায় যাচ্ছেই না! পুলিশের অত্যাচারে আমাদের ব্যবসা মার খাচ্ছে।''
পুরনো দিন থেকে এখন... ল্যাংচার স্বাদ কী বদলেছে? আফশোস উগড়ে দিলেন এক দোকানী '' আগে সব টাটকা জিনিস মিলত! এখন দুধ, ঘি, চিনি সবেতেই ভেজাল! যুগের হাওয়া পরিবর্তণ হলে স্বাদে বদল আসবেই! খারাপ লাগে, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই! সবাই শুধু লাভের দিকটা দেখছে, মানুষের কাছে ভাল জিনিসটা পৌঁছে দেওয়ার ইচ্ছে কারও নেই!''
বর্ধমান পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত শক্তিগড়! আসন পুনর্বিন্যাসের আগে বর্ধমান পূর্ব নামে কোনও লোকসভা কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল না। যে অঞ্চল নিয়ে এই কেন্দ্রটি তৈরি হয়েছে, তার অধিকাংশই সে সময়ে কাটোয়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ছিল, যে আসন এখন অবলুপ্ত। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে বামেদের দখলে গিয়েছিল বর্ধমান পূর্ব, জিতেছিলেন সিপিএমের অনুপকুমার সাহা। ২০১৪ সালে তৃণমূলের সুনীল মণ্ডল মোট ৫৭৪৫৬০ সংখ্যক ভোট পেয়ে হারিয়ে দিলেন বামফ্রন্টের ঈশ্বরচন্দ্র দাসকে। ঈশ্বরবাবু পেয়েছিলেন ৪৬০১৮১-টি ভোট! সুনীল মণ্ডল অবশ্য এক সময় ছিলেন বাম শিবিরেই, গলসির ফরওয়ার্ড ব্লকের বিধায়ক। পরে তৃণমূলে যোগদান করেন এবং পূর্ব বর্ধমান থেকে প্রার্থী হন। এবারের লোকসভা ভোটেও তিনি এই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী! লড়াই সিপিআইএম-এর - ইশ্বরচন্দ্র দাস ও কংগ্রেস-এর সিদ্ধার্থ মজুমদারের সঙ্গে!
শক্তিগড়ের ল্যাংচা ব্যসায়ীদের দাবী, '' সরকার তাঁদের দিকে নজর দিক! কীভাবে ল্যাংচা ইন্ডাস্ট্রি আরও বড়, উন্নত করা যায় সে বিষয়ে ভাবুক, তাঁদের সাহায্য করুক!''
ফুটে উঠল এক ময়রার ক্ষোভ,'' সবার আগে সরকার দেখুক যাতে নিজের ভোট নিজে দেওয়া যায়! গতবার লোকসভা ভোটে আমি ভোট দিতে পারিনি! ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখি আমার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিয়েছে!''
ল্যাংচার পাশাপাশি শক্তিগড় বিখ্যাত সীতাভোগ আর মিহিদানার জন্যও! ব্যবসায়ীদের ভাষায়, ভেজালের বাজারে এই দুই 'যমজ' মিষ্টিও 'অরিজিনাল' স্বাদ হারিয়েছে! বলা হয়, ১৯০৫ সালে র্ধমানের রাজার আমন্ত্রণে শহরে এসেছিলেন লর্ড কার্জন। । চারদিকে হই হই ব্যাপার। তৈরি হল বিজয় তোরণ বা কার্জন গেট। কিন্তু, কী মিষ্টি দিয়ে স্বাগত জানানো হবে বড়লাটকে? বিপাকে পড়ে রাজা বিজয়চন্দ ডেকে পাঠালেন প্রসিদ্ধ মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক ভৈরবচন্দ্র নাগকে। রাজ-নির্দেশে তিনি এমন মিষ্টি বানালেন, যা খেয়ে আপ্লুত সস্ত্রীক কার্জন। সেই থেকে সীতাভোগ আর মিহিদানার পথ চলা শুরু!
ল্যাংচার যাত্রা শুরুর পিছনে অবশ্য রয়েছে এক মজার ঘটনা! নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বর্ধমানের রাজপুত্রের সঙ্গে। কয়েক বছর পর রাজকন্যা সন্তানসম্ভবা হন। কিন্তু সমস্যা হল, তাঁর মুখে কিছুই রোচে না। যা খান তাই বমি করে ফেলেন! সবার মাথায় হাত! কী হবে এবার? একদিন শাশুড়িমা তাঁকে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, '' বলতেই হবে কী খেতে ইচ্ছে করছে!'' রাজকন্যা আচমকা বলে বসলেন 'ল্যাংচা'। কিন্তু ল্যাংচা যে কী খাদ্যবস্তু তা আর কিছুতেই বলেন না ! তবে সেদিন রাতে রাজকন্যা স্বামীকে জানিয়েছিলেন ল্যাংচার বৃত্তান্ত! পরদিন রাজপুত্র মা-কে ডেকে জানালেন, 'ল্যাংচা' একধরনের মিষ্টি যা রাজকন্যা কৃষ্ণনগরে খেয়েছেন। খেতে অনেকটা পান্তুয়ার মতো! যে এই মিষ্টিটা তৈরি করত তার একটা পা ছিল খোঁড়া। কাজেই রাজকন্যা মুখ ফসকে বলে ফেলেছে ল্যাংচা! রাজমহিষী এই কথা জানালেন বর্ধমানরাজকে। তৎক্ষণাৎ অশ্বারোহী ঘোড়া ছোটালেন নদিয়ার দিকে। অনেক খোঁজের পর সেই ময়রার দেখা মিলল। তাঁকে নিয়ে আসা হল বর্ধমানে! বড়শূল গ্রামে ময়রাকে একটি ভূসম্পত্তি দান করলেন রাজা আর শক্তিগড়ে রাস্তার উপর বানিয়ে দিলেন একটি দোকান। প্রতিদিন সেখানে একমণ করে ল্যাংচা বানানো হত যা রাজকন্যার জন্য পাঠানো হত বর্ধমান রাজপ্রাসাদে। সেই থেকে শক্তিগড়ে গড়ে উঠল ল্যাংচার রাজত্ব!
কিন্তু সেই রাজত্বে এখন ঘুণ ধরছে! অসন্তোষ জন্ম নিয়েছে ব্যবসায়ীদের মনে! খুশি নন ক্রেতারাও! শান্তিনিকেতন থেকে ফিরতি পথে শক্তিগড়ে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতার বাসিন্দা অর্ণব সরকার, ল্যাংচায় কামড় দিতেই দিতেই জানালেন, '' ১০টাকার ল্যাংচায় আগে ঘিয়ের গন্ধ মম করত, এখন নেই বললেই চলে! ভিতরে ক্ষিরের পুরও আগের মতো আর তুলতুলে নরম নয়। ৫টাকার ডালদায় ভাজা ল্যাংচা তো মুখেই তোলা যায় না!''
ভবিষ্যতে কী হবে? বাংলার ঐতিহ্য ল্যাংচা কবে আবার আগের 'ফর্ম'-এ ফিরে আসবে? সরকারের দিকে মুখ চেয়ে ল্যাংচা প্রস্তুতকারকেরা! তাঁদের আশা, এই লোকসভা ভোটে নিশ্চয়ই সমস্যার সমাধান হবে!