#খড়দাহ: কলকাতার কাছেই এ এক 'অন্য' ছিটমহল। না পঞ্চায়েত, না পুরসভা। তাহলে কার অধীনে পাতুলিয়া? প্রতি বর্ষায় নিয়ম মেনে জল জমে। উপচে পড়ে নালা। যত্রতত্র পড়ে থাকে আবর্জনার পাহাড়। আমফানের সময় প্রবল বৃষ্টির পরেও দীর্ঘদিন কার্যত জলে ডুবেছিল ঘরবাড়ি। রীতিমত নরক যন্ত্রণায় দিন কেটেছে বাসিন্দাদের। প্রকৃতির জল আর নালার জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই দিন কেটেছে আট থেকে আশির। কিন্তু খড়দহের পাতুলিয়া সরকারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট নিয়ে কারোর কোনও মাথাব্যথা নেই।
তবে শুধু যে আমফান পরবর্তী পরিস্থিতিতেই নিদারুণ সমস্যার মধ্যে পড়েছেন নাগরিকরা, তা নয়। সারা বছরই নাগরিক পরিষেবা পাওয়া থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত এখানকার প্রায় সাড়ে সাতশ পরিবার। যত্রতত্র ময়লা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকার মধ্যেই এলাকার শিশুরাও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেই বেড়ে উঠছে। তবে বর্ষা আসলেই বাসিন্দাদের কপালের চিন্তার ভাঁজ আরও মোটা হয়। ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে জল। বেহাল নিকাশির কারণে নর্দমার জলও নিত্যসঙ্গী হয় পাতুলিয়ার। কারও কোনও হেলদোল নেই । নাগরিক পরিষেবা পাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত স্থানীয় বাসিন্দারা। নেতা থেকে প্রশাসন সবার কাছে বহুবার দরবার করেও মেলেনি কোনও সুফল। না খড়দহ পুরসভা না পাতুলিয়া পঞ্চায়েত-- কেউই এখানকার বাসিন্দাদের পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না।
রয়েছে ভোটার কার্ড । লোকসভা কিংবা বিধানসভা ভোটে অংশ নিলেও পাতুলিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের বাসিন্দারা পুরসভা কিংবা পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন না। আর এখান থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকার পুনর্বিন্যাসের কাজ না হওয়ায় এই অঞ্চলটি বর্তমানে না খড়দহ পুরসভা না পাতুলিয়া পঞ্চায়েতের অধীনস্থ। আর এই টানাপোড়েনেই লাল ফিতের ফাঁসে আটকে এলাকার উন্নয়ন। ব্রাত্য আস্ত একটা মহল্লা। তাই বঞ্চনা আর দুর্ভোগকে সঙ্গী করেই দিন গুজরান করে চলেছেন হাজার হাজার নাগরিক। দীর্ঘদিন যাবৎ এলাকার পুনর্বিন্যাস না হওয়ার কারণেই যে নাগরিক পরিষেবা দেওয়ার ব্যাপারে সমস্যা হচ্ছে তা মেনে নিয়েছে শাসক দল।
ব্যারাকপুর দু’নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সুকুর আলির কথায়, 'আমরা সাধ্যমত পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। তবে আমাদেরও ক্ষমতা সীমিত'। তাই পাতুলিয়া ওই অঞ্চল যে এক প্রকার 'ছিটমহল' হিসেবেই পরিচিত সেকথাও মেনে নিয়েছেন তিনি । কেন এতদিন পাতুলিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসটেটের পুনর্বিন্যাস হয়নি ? এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে সরকারি এক আধিকারিকের আশ্বাস, 'আগামী বছর পুনর্বিন্যাসের সময় হয় পঞ্চায়েত না হলে পুরসভার অধীনে যাতে ওই এলাকাটি যায় তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে'। স্থানীয় বাসিন্দারা এই আশ্বাসের পরেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁদের কথায়,' এরকম আশ্বাস ঢের মিলেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি'।
ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী, আশীষ চক্রবর্তীর মতো আরও অনেকেরই বক্তব্য,'ভোট আসে ভোট যায় । সমস্যা যে তিমিরে থাকে সেই তিমিরেই রয়ে যায়। কেউ আমাদের কথা ভাবে না। সবাই নিজের নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যায়"।পঞ্চায়েত আর পুরসভার টানাপোড়েনে ভরা বর্ষায় ঘরের ভেতর জল জমলে অথবা এলাকার জঞ্জাল সাফাই, নালা পরিষ্কার সহ নাগরিক পরিষেবার অন্যান্য বিষয়ও নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করেই করতে হয়। নজর নেই কারোর। ছ দশকের যন্ত্রণা।
এখন যেন যন্ত্রণার সঙ্গেই আপোস করে নিয়েছে পাতুলিয়া। নাগরিক পরিষেবা সম্পূর্ণ শিকেয় উঠেছে। পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থার কোনও পরিকাঠামো না থাকায় ক্রমেই অবাসযোগ্য হয়ে উঠছে এলাকা। অনেকেই ঘর তালাবন্ধ করে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। আর যাঁরা নিরুপায় সেই সমস্ত পরিবার প্রতি মুহূর্তে এক কঠিন বাস্তবের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। যে লড়াইয়ের শেষ কবে জানা নেই ওঁদের। খড়দহ। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের বিধানসভা এলাকা। শাসক দলের সাংসদ সৌগত রায়ের দমদম লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত খড়দহের পাতুলিয়ার অসহায় মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা আদৌ কি মিটবে ? নাকি আগামী দিনেও 'ছিটমহল' হিসেবেই থেকে যাবে ? উত্তর দেবে সময়ই।