#কলকাতা: "মেয়ে আমার কাছে গর্ব। ওর জন্য গর্বে আমার বুক ফুলে যায়।"- ধর্মতলাগামী ৩৪সি রুটের বাসে চালকের আসনে মেয়ে কল্পনার পাশে বসে একথা বলছিলেন বাবা সুভাষ মন্ডল।
বলবেন নাই বা কেন, বছর কয়েক আগে দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে মেয়েই যে সংসারের চালিকাশক্তি। শুধু বাসের নয়, গোটা সংসারের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছে আঠারোর গন্ডিতে থাকা কল্পনা।
ন'পাড়া-ধর্মতলা রুটের ৩৪সি বাসে যারা যাতায়াত করেছেন তাদের প্রত্যেককেই গত আট মাসে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে কল্পনা।
বছর কয়েক আগে তার বাবা সুভাষ ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তাতে পা বেঁচে গেলেও বাসের শক্ত ব্রেক ও অ্যাকসিলারেটর চেপে দীর্ঘক্ষণ বাস চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাও সংসার চালাতে সুভাষ কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাবার সেই কষ্ট সহ্য হচ্ছিল না কল্পনার। রোজকার মত একদিন দুপুরে খাবার দিতে গিয়ে কল্পনা তার বাবাকে পায়ের ব্যাথায় কাতরাতে দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। জেদ চেপে বসে মেয়ের। বাবার থেকেই ধীরে ধীরে শিখতে শুরু করে বাস চালানো। প্রথমে বাস স্টার্ট দিয়ে আগে-পিছে করা। তারপর রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলে বাস নিজে চালিয়ে ডিপো অবধি নিয়ে যেতে শুরু করে। সে সময় অবশ্যই পাশে বসে থেকে সাহস দিতেন কল্পনার বাবা। শুধু বাবা নয়, মা মঙ্গলা মন্ডলও বাসেই থাকেন। এভাবেই পাকা চালক হয়ে উঠেছে সে। কল্পনার কথায়, "বাবার পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই গাড়ি চালানো শুরু করি। বাবার থেকেই বাস চালানো শিখে নিই। এখন আমি পাকা চালক। বাবা দুটো ট্রিপ করে। বাকি ট্রিপ আমি করি। তবে বাবা মা সব সময় আমার পাশে থাকে।"
কল্পনা সত্যিই এখন পাকা চালক। কারণ একজন বাস চালক শুধু ভালো বাস চালাতে পারলেই হয় না। বাসের ঘন্টির আওয়াজ শুনে সংকেত বোঝাটাও জরুরি। কি সেই সংকেত? কল্পনা জানে, কন্ডাক্টর একবার ঘন্টি বাজানো মানে পুরুষ যাত্রী নামবে। দু'বার ঘন্টি বাজানো মানে ছাড়তে হবে বাস। তিনবার ঘন্টি বাজানো মানে মহিলা যাত্রী নামবে। সংকেত বুঝেই চালাতে হয় বাস। তার কথায়, "শুরুতে বুঝতে একটু সমস্যা হতো। এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।"
কল্পনা চায় তার বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ করতে। সুভাষের স্বপ্ন ছিল পুলিশ ড্রাইভার হওয়ার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তাই কল্পনা এখন স্বপ্ন দেখে পুলিশের ড্রাইভার হয়ে বাবার ইচ্ছে পূরণ করার। কিন্তু মাঝপথেই আটকে রয়েছে তার স্বপ্ন। কারণ বাবার দুর্ঘটনার পর সংসারে আচমকা চরম আর্থিক অনটন এসে পড়ে। তার জেরে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরনো হয়নি। তবে আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করে স্বপ্নের পথে এগোতে চায় সে।
ন'পাড়া থেকে ধর্মতলার পথে যাওয়ার সময় অনেক যাত্রীই প্রথমে চমকে উঠতেন ছোট্ট হাতে স্টিয়ারিং দেখে। কিন্তু এখন এই দৃশ্য যাত্রীদের অভ্যাস। ওই ছোট হাতেই ভরসা এখন। সেরকমই এক যাত্রী বলেন, "ছোট হাতে বড় কাজ করে মেয়ে পরিবারকে সাহায্য করছে দেখে ভালো লাগে। চালকের আসনে কল্পনা থাকলে আমরা এখন নিশ্চিন্ত থাকি। ও যেন নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে এটাই প্রার্থনা করি।"
মেয়ের হাতে স্টিয়ারিং দিয়ে কি নিশ্চিন্ত বাবা?
সুভাষের কথায়, "ওকে সাহস না দিলে বড় হবে কি করে। প্রথম প্রথম ওর পাশে বসে থাকতাম। এখন না থাকলেও চলে। এত অল্প সময়ে সব শিখে গিয়েছে ভাবতেও পারি না।"
রোজ বাবার সাথেই ভোর ৪ টেয় ঘুম থেকে ওঠে কল্পনা। তারপর মায়ের সাথে ঘরের কাজ সামলে বাবাকে দুপুরে খাবার দিতে যায় বাস ডিপোতে। তখন থেকেই স্টিয়ারিং তার হাতে। রাত আটটা কিংবা ন'টায় শেষ ট্রিপ। তারপর টাকা পয়সার হিসেব করে বাড়ি ফিরতে এগারোটা পেরিয়ে যায়। তবু এই ব্যস্ততার মাঝেই পড়াশুনা করে এগিয়ে যেতে চায় সে।
কল্পনা বাস চালাতে শিখে গেলেও এখনও বাসেই মেয়ের সঙ্গে সবসময় থাকে মা মঙ্গলা। যেন বাসেই তাদের সংসার। মায়ের কথায়, "স্বামীর দুর্ঘটনার পর মেয়ে সংসারের হাল না ধরলে কি যে হত কে জানে। আমার মেয়ে আমার কাছে গর্ব।"
সংসার চালাতে বাস, ট্যাক্সি, অটো চালাতে এ শহরে অনেক মহিলাকেই দেখা যায়। কিন্তু এত অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে বাস চালানো নজিরবিহীন। তাই এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে কল্পনাকে কুর্নিশ।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।