#কলকাতা: এলেন..দু’চোখ ভরে দেখলেন তিলোত্তমাকে। কারোর মনে পড়ল পুরনো কথা। কেউ আবার প্রথম আলাপেই আপন করে নিলেন এ শহরকে। সেই আনন্দের রেশ ছড়াল শহরের ঘুমিয়ে পড়া এক অন্য সত্তায়। চেনা চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এ শহরে পৌঁছে ওঁদের সাদা থানেও খুশির রং। বৃন্দাবন থেকে কলকাতা বেড়াতে এসে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে ললিতা, প্রমীলা, সাবিত্রীদের আনন্দ আর ধরে না। ট্রামে চেপেও শিশুর মত উচ্ছ্বল ওঁরা।
বৃন্দাবনের বিধবাদের কলকাতা ঘুরিয়ে দেখাল এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রায় জীবন সায়াহ্নে পৌঁছনো কিছু মানুষ, একদিনের জন্য এ শহর ঘুরে সঙ্গে নিয়ে গেলেন বাঁচার রসদ। ওঁদের কারোর বয়স ৬৫, কারোর বা ৫৫। বয়সের ফারাক থাকলেও এঁরা সবাইকেই একটি শব্দবন্ধনেই চেনা যায়। যে শব্দ কেড়ে নিয়েছে ওদের জীবনের রঙ। এঁরা প্রত্যেকেই বিধবা।
চল্লিশটা বসন্ত পেরিয়েছে অনেকদিন আগেই। চালশে পড়েছে চোখেও। ঝাপসা দৃষ্টিতেও কিন্তু মন-নদীতে পলি পড়েনি। জীবনের ঝড়-ঝাপটা মুখে চোখে এঁকে দিয়েছে গভীর বলিরেখা। এঁদের কেউ মুর্শিদাবাদ, কেউ বা উত্তর দিনাজপুর, কেউ বা আবার রাজস্থানের প্রত্যন্ত কোনও গ্রাম থেকে বৃন্দাবনে পাড়ি দিয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর একা হয়েছেন সংসারে। দেখার কেউ নেই। পরিবারের কথা বলতে গেলে দুঃখ ছাপিয়ে আসে দু’চোখে। কেউ খোঁজও নেয় না কোনওদিন। বৃন্দাবনের আশ্রমে দিন কাটে শেষের সে দিনের অপেক্ষায়। আছে দুঃখ... আছে মৃত্যু..
এঁদের নিয়েই কলকাতা ঘুরে গেল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যে শহরে আগেও হয়তো কেউ এসেছিলেন স্বামীর হাত ধরে। আবার কেউ হয়তো এই প্রথম দেখছেন রাজ্যের রাজধানী শহরকে। কত্ত্বদিন পর বৃন্দাবনের বাইরে। শেষ কবে বেরিয়েছিলেন এখন মনেই পড়ে না। চারিদিকে সব কিছুই নতুনের মত।সময় না মানসিকতা, কিছু কি পাল্টেছে? বিধবা মানেই সাদা থান, নিরামিষ আহার, ছোট করে ছাঁটা চুল, গৃহবন্দী।
স্বামী বিয়োগের পর জীবনের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বাবার বা শ্বশুরের সংসারে কোনওরকমে মাথা গুঁজে থাকা। এটাই নিয়ম আর অনুশাসন। ঠিক করে দিয়েছিল সমাজ। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল, সময়ের তাগিদে শুধুমাত্র চরিত্রের নাম বদলেছে। চুনীবালা থেকে পদ্মজা। ছবিটা খুব চেনা। বাল্য বিধবাদের বাবার সংসারে ফিরিয়ে আনার পরের যে ছবি, তা অনেকদিন আগেই আমাদের দেখিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকেই ইন্দিরা ঠাকুরণ হিসেবে সিনেমায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্যজিত রায়। বিধবা বৃদ্ধা, স্বামীহারা, সন্তানহীন, ভাইয়ের ইচ্ছায় পৈতৃক ভিটেতে একটি ঘরে তাঁর বরাদ্দ । ইন্দিরা ঠাকরুনের চরিত্র আসলে সে সময়কার সমাজের ছবি।
তবে সবাইকে যে এরকম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হত, তা নয়। স্বচ্ছল পরিবার হলেও ছবিটা খুব একটা বদলাত না। উপেক্ষার ভারটা ছিল একই। অন্দরমহলের সামলানোর দায়িত্ব থাকত বিধবাদের উপরেই। শখ, আহ্লাদ, চাহিদা বিসর্জন দিয়ে সংসারের চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়ার শপথ নিতেন তারা। কিন্তু এখন কিছুটা হলেও দিন বদলেছে। স্বামী বা নিজের ভিটেতে কারোর গলগ্রহ হয়ে থাকার বদলে এখন স্বাবলম্বী হতেও পিছপা নন তাঁরা।
পারিবারিক টানাপোড়েন, অশান্তি, আর সব পিছুটান ছেড়ে তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন যমুনার তির বৃন্দাবনে। হয়তো এই লড়াইটাও সহজ ছিল না। চেনা পরিচিত বৃত্তের বাইরে গিয়ে অচেনা অজানা পরিবেশে মানিয়ে নেওয়াও তো সহজ নয়। কিন্তু পেরেছেন ওঁরা। তাই জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ওঁদের মুখে বিজয়ীর হাসি।
সংসার থেকে চাওয়া পাওয়া নেই। জীবন নদীর স্রোত থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছেন তাঁরা। তবু বুক ঠেলে ওঠে মান অভিমান। অজান্তেই জলে ভরে আসে চোখ। ভাবনার হিজিবিজি কোঁচকানো ত্বকে। কিন্তু চিন্তা ভাগ করবেন কার সঙ্গে? সবাই তো বলতেই চান। অনর্গল। জমে থাকা কথা। কাছের মানুষকে। বন্ধুকে। ছেলেকে। মেয়েকে। শোনার যে কেউ নেই। কষ্ট গিলতে গিলতে এখন তেমন কথা বলতেই পারেন না। তবুও খুশির ঝিলিক উঁকি দেয় চোখে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে শিশুর মত হেসে ওঠেন। ট্রামে চড়ার জন্য বাচ্চাদের মতো হুড়োহুড়ি করেন। বেলুড়মঠে গিয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করেন প্রাণের দেবতাকে। বাড়ির কথা মনে পড়ে। বিবর্ণ, হলদেটে ছবির মত স্মৃতি ঘাঁটলেই উঠে আসে কান্না। কিন্তু তাঁরা জানেন, সংসারের সব লড়াই তাঁর শেষ।
একদিনের জন্যে সময় বোধহয় থমকে গিয়েছিল ওঁদের সবার কাছে। এমনি করে যায় যদি দিন যাক না ৷ নাঃ, কোনও অভিযোগ নেই। এখন বৃন্দাবনে বেঁচে থাকার লড়াইকেই সম্বল করেছেন তারা। কিন্তু প্রথমদিককার সেই সব দিনও তো খুব সহজ ছিল না। এখন নিজের কাজটুকু নিজেরাই করে নেন। সংস্থার উদ্যোগে কিছুটা রোজগারও করেন। দু’দিনের কলকাতা সফর শেষ। মনের গভীরে ভাললাগা নিয়েই ওঁরা ফিরছেন বৃন্দাবনে।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Kolkata, Vrindavan, Widow, Widow Kolkata Tour