#কলকাতা: বিজ্ঞানে বাঙালির জয়যাত্রার ইতিহাস কুসুমাস্তীর্ণ বললে এতটুকুও বাড়িয়ে বলা হয় না। জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশ...কৃতি বিজ্ঞানীদের নাম গুনে শেষ করা যাবে না। তবে বিজ্ঞানসাধক বাঙালি দশকে দশকে বিশ্বের কুর্নিশ কুড়োলেও সত্যটা পানসে। নোবেল মঞ্চে গত ১১৯ বছরে কোনও বাঙালি বিজ্ঞানীর ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। নোবেল পেয়েছেন ভারতীয় বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর বেঙ্কটরামন, সুব্রক্ষ্মণ্য চন্দ্রশেখর, বেঙ্কটরামন রামাকৃষ্ণণরা, কিন্তু ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে বাঙালিরা। তবে এই কাটা ঘায়ে যেন খানিকটা শুশ্রুষার প্রলেপ পড়ল বুধবার, যখন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন স্যার রজার পেনরোজ। রাতারাতি বেরিয়ে পড়ল তাঁর বং কানেকশান। বিশ্বের তাবড় পদার্থবিদের মুখে এখন ঘুরছে এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম। তিনি অমলকুমার রায়চৌধুরী। শাখা নির্বিশেষে একবাক্যে মানছেন রোজের এই সাফল্যের ভিত্তিভূমিটা করা অমলকুমার রায়চৌধুরীরই।
বরিশালের এক স্কুলশিক্ষকের সন্তান অমলকুমার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ১৯৪২ সালে। সেখান থেকে গবেষণার কাজে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশান ফর কাল্টিভেশান সায়েন্স। কিন্তু ক্রমেই এই গবেষণা তাঁকে নিরুৎসাহ করে। লেকচারার হিসেব যোগদান করেন আশুতোষ কলেজে। শুরু হয় গুরু ধরে আপেক্ষিকতাবাদ চর্চা। গবেষণা করতে করতে একদিন বলে ওঠা 'ইউরেকা', অর্থাৎ পেয়ে গিয়েছি।সামনে আসে রায়চৌধুরী সমীকরণ। এই সমীকরণ আক্ষরিকই বদলে দিয়েছে কৃষ্ণগহ্বর তত্ত্ব জানা বোঝার পরিসর। তাঁর সমীকরণকে সামনে রেখেই চর্চা চালিয়ে গিয়েছেন স্টিফেন হকিংস এবং রজার পেনরোজরা। আর সেই চর্চার বীজই আজ একটু একটু করে ডানা মেলে স্বপ্নের উড়াল দিয়েছে বিশ্বমঞ্চে। নোবেল-প্রসাদ জোটেনি বাঙালির তাতে কি, মিনারের ভিতটা তো তাঁর হাতেই গড়া, বলছেন অনেকে।
কৃষ্ণগহ্বর চর্চাকে ঠিক কী ভাবে এগিয়ে দিয়েছিল রায়চৌধুরী সমীকরণ? বলছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ কলকাতা (আইসার)’-র পদার্থবিজ্ঞানী তথা অমলবাবুর ছাত্র নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্য়ায়, "রায়চৌধুরীর সমীকরণ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। তখন গোটা বিশ্বেই খুব কম লোক বিষয়টি নিয়ে কাজ করতেন। ফেড হয়েলের মতো বিজ্ঞানীরা কিন্তু দ্রুত বুঝে যান অসাধ্যসাধন করেছেন অমলবাবু।"
কী ভাবে? নারায়ণবাবু বললেন, আইনস্টাইনের সমীকরণে বস্তুর কোনও সিঙ্গুলারিটি থাকে না। কারণ তা একটি অনন্ত জ্যামিতিক বিন্যাস, পরিমাপই সম্ভব নয়।এখন বস্তুর সিঙ্গুলারিটি হবে কি হবে না তা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই রায়চৌধুরী ইকুয়েশান। এই সিঙ্গুলারিটি থিয়োরাম চর্চা শুরু হতেই জনপ্রিয় হতে থাকে রায়চৌধুরী ইকুয়েশান। স্টিফেন হকিং-পেন রোজ '৭০ সালে এক বাক্যে স্বীকার করে নেন, রায়চৌধুরীর সমীকরণই সিঙ্গুলারিটি বোঝার স্তম্ভ।
কৃষ্ণগহ্বরের সঙ্গে রায়চৌধুরী ইকুয়েশানের সম্পর্ক কী? পদার্থবিদরা বলছেন, কসমোলজি দেখায় বিগ ব্যাং থেকেই আমাদের জন্ম। এটাও একটা সিঙ্গুলারিটি। আবার আমাদের পরিণতির কথা বলে কৃষ্ণগহ্বর। এই দুই চর্চাতেই অমল রায়চৌধুরীর সমীকরণ কাজে লাগে। এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
সারা জীবন ধরেই কাজ করে গিয়েছেন অমল রায়চৌধুরী। ৭৫ বছর বয়সে মাথা ছিল ২১ বছরের যুবকের মতো সফল। কোনও সাহায্য ছাড়া এই সময়ে তিনি অঙ্ক কষে দেখান, সিঙ্গুলারিটি ফ্রি সলিউশনের ক্ষেত্রে বস্তুর ঘনত্ব শূন্য। অর্থাৎ বস্তুই যদি না থাকে তাঁর মাধ্যাকর্ষণেরও প্রশ্ন নেই। ফলে সিঙ্গুলারিটি না থাকাটাও সম্ভব।
অমলবাবুর ছাত্ররা বলেন, সাদামাটা জীবনই ছিল অমলবাবুর বৈশিষ্ট্য। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেএ রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল প্রখর। সে কথা জানান দিয়েছেন নিজের লেখনীতে। খ্যাতির পিছনে ছোটার মোহ ছিল না তাঁর, থাকলে অক্লেশেই পাশ্চাত্যে সুখের জীবন কাটাতে পারতেন। অথচ আজীবন রইলেন কলকাতা শহরেই, খ্যাতির বিপ্রতীপে। তাঁকে মরিয়া হয়ে খুঁজতে হতো প্রতিষ্ঠানকেই। ছাপোষা শিক্ষক হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
বাঙালি বিজ্ঞানসাধকরা কেন নোবেল পায়নি তাই নিয়ে আজ আফশোস করতে রাজি নন এই শহরের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, সত্যেন বোস-মেঘনাদ সাহা-অমলকুমার রায়চৌধুরীকে পেয়েছি। বিজ্ঞানের বিশ্বে এই জাতির গুরুত্ব অক্ষরে অক্ষরে লেখা আছে, তা প্রমাণ হল নোবেল মঞ্চেই।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Nobel Prize2020