#কলকাতা: গুজরাত নির্বাচনের দিন ক্রমশ সামনে আসছে।পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্যাটেল ভোটের সমীকরণ নিয়ে জল্পনা। হার্দিক প্যাটেলের জনপ্রিয়তার গ্রাফ ক্রমশ উর্দ্ধমুখী। কতটা, তার একটা আন্দাজ দিতে পারে একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা।একটি সর্বভারতীয় সংবাদগোষ্ঠীর সমীক্ষায়, এই মুহুর্তে প্যাটেলদের মধ্যে ৬৪ শতাংশই হার্দিকের পক্ষে।গত চারমাসে ৩ শতাংশ বেড়েছে পতিদারদের নতুন নেতার জনপ্রিয়তা। নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ জুটির কাছে পরিসংখ্যানটা অবশ্যই স্বস্তির নয়। প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে গুজরাত নির্বাচনই মোদির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
মোদি অনুগামীরা একথায় রে রে করে উঠতেই পারেন। কিন্তু, সত্যিটা হল, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে মোদির কোনও প্রতিপক্ষই ছিল না। বাবা-ছেলেতে বিভক্ত যাদব পরিবার, শুধুমাত্র মুসলিম তাস খেলে বাজিমাত করতে চাওয়া মায়াবতী আর উত্তরপ্রদেশে এখনও কোনও নেতার অপেক্ষায় থাকা কংগ্রেস--রামরাজ্যে মোদি কার্যত ফাঁকা মাঠ পেয়েছিলেন।সঙ্গে জুড়েছিল রাহুল গান্ধিকে নিয়ে কংগ্রেসের চিরাচরিত ‘টু বি অর নট টু বি’ জাতীয় ধন্দ।ঠিক কোন নির্বাচনে রাহুল গান্ধিকে নেতা ঘোষণা করে লড়লে, পরাজয়ের কলঙ্ক তার ধবধবে সাদা কুর্তায় লাগবে না, সেই হিসাবের উত্তর তখনও কংগ্রেস হাইকমাল্ডের কাছে ছিল না।ফলে কার্যত কোনও বিরোধী চ্যালেঞ্জই ছিল না প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের সামনে। সদ্য নোটবাতিলের সূত্রে প্রধানমন্ত্রীর ‘গরীবের মসীহা’ মার্কা ভাবমূর্তির সামনে খড়কুটোর মত উড়ে গিয়েছিল বিরোধীরা।
একবছর পর এখন পরিস্থিতি অনেকটাই বদলেছে। নোটবন্দীর পর জিএসটির ধাক্কায় বেসামাল গোটা দেশের ছোট ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসায়ীরা। সবচেয়ে বড় আঘাত নেমেছে গুজরাতের বস্ত্রশিল্প,হিরে ব্যবসা ও রিয়াল এস্টেটে।আর এই তিনটি ক্ষেত্রেই ব্যবসার সিংহভাগ প্যাটেলদের কব্জায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিও তাই হার্দিক প্যাটেলের ‘বিরাদরি’কেই বইতে হয়েছে।আর ঠিক এই কারণেই গত চারমাসে লাফিয়ে বেড়েছে হার্দিকের প্রতি সমর্থন। দলিত নেতা জিঘনেশ মেওয়ানির জনপ্রিয়তাও গত কয়েকমাসে ৬ শতাংশ বেড়েছে। কারণ, ক্ষেত মজুরি ও নির্মাণ শিল্পের মত নগদ নির্ভর ব্যবসায় শ্রমিকের কাজ করেই তাদের সংসার চলে। নোটবাতিলের কোপে তারাই সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছেন। মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানো বা মেথরের কাজ করা দলিতরা আবার গো-রক্ষী আর উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বারবার। প্যাটেল-দলিত জোড়া ফলায় বিদ্ধ মোদি -শাহ জুটি তাই প্রায় গোটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকেই গুজরাতের ময়দানে নামিয়ে দিয়েছেন। তবে এই পরীক্ষার মরসুমে ছাপান্ন ইঞ্চির ছাতির মালিককে সবচেয়ে বেশি যে কাঁটার খচখচানি সহ্য করতে হচ্ছে তার নাম প্যাটেল ভোট।
Loading...
এতকিছুর পরেও অবশ্য সে ভোটের গোটাটাই বেহাত হওয়ার আশঙ্কা প্রায় নেই বললেই চলে।তার কারণ লুকিয়ে আছে প্যাটেলদের জন্মবৃত্তান্তে।প্যাটেলরা আসলে কোনও একছাঁচে গড়া, সমসত্ত্ব,সমস্বার্থের জনগোষ্ঠী না। তাদের উদ্ভব আর বিকাশের ইতিহাসেই আপাতত স্বস্তির মলম আছে গুজরাটের বিকাশ পুরুষের জন্য।গুজরাটের জনসংখ্যার প্রায় সতেরো শতাংশই হিন্দু প্যাটেল।মুসলিম প্যাটেলরা নির্বাচনী পাটিগণিতে কোনও ফ্যাক্টর নয় এটা তাদের সংখ্যা আর রাজনৈতিক ইতিহাসই বলছে। গুজরাটের এই হিন্দু প্যাটেলরা মোট ১৮২-র মধ্যে আশিটি বিধানসভা কেন্দ্রে জয়-পরাজয়ের নির্ণায়ক।বর্তমান রাজ্য বিধানসভার এক তৃতীয়াংশ বিজেপি বিধায়ক, প্যাটেল গোষ্ঠীভুক্ত। ঐতিহাসিক নানা মতভেদ থাকলেও, প্যাটেল জনগোষ্ঠী যে একাদশ শতাব্দীতে গুজরাটে আসেন, মোটের উপর সে বিষয়ে সব ঐতিহাসিকই একমত। আফগান আক্রমণের সময় জান-মান-সম্পত্তি বাঁচাতে পঞ্জাব থেকে রাজস্থানের মেবার হয়ে প্যাটেলরা গুজরাতে আসেন।অধুনা পাকিস্তানের গুজরানওয়ালা থেকেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় এঁরা এসেছিলেন।তাদের আদি বাসস্থানের নাম থেকেই নাকি অধুনা গুজরাতের নামকরণ।অনেক ঐতিহাসিক অবশ্য বলেন প্যাটেলদের আদি পূর্বপুরুষ গুর্জ্জররা।সেখান থেকেও গুজরাট নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। কারণ যাই হোক,প্যাটেলদের অতীতের সঙ্গেই যে গুজরাটের নামকরণ জড়িয়ে আছে এতে রাজ্যে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি সহজেই প্রমাণিত।
তবে এ হেন প্যাটেলরা নিজেদের বর্ণগত পরিচয় নিয়ে বহুবিভক্ত। একদল অনজানা প্যাটেল এরা বৈশ্য। কয়েক’শ বছর ধরে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এমনকি বানিয়াদের কাছেও জল-অচল।এরা ওবিসি হিসেবে ইতিমধ্যেই সংরক্ষণের আওতায়। এরা মূলত আমেদাবাদ,সবরকন্ঠা,বনসকন্ঠা ও মেহসানায় প্রতিষ্ঠিত এবং অধিকাংশই আজ বিজেপির নিশ্চিত ভোটব্যাঙ্ক।আরেক দল, আঘারিয়া প্যাটেল। এরা বহু আগে থেকেই মূলত আমেরিকা,কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে প্রবাসী। দেশে এদের যে আত্মীয়-পরিজন থাকেন তাঁরা বেশিরভাগ কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও রক্ষণশীল।জনসংঘ ও স্বতন্ত্র পার্টির সময় থেকে এরা প্রকাশ্যেই কংগ্রেস বিরোধী।
তাহলে হার্দিক প্যাটেল কাদের জন্য লড়ছেন? হার্দিকের লড়াই কডবা বা কদবা প্যাটেল আর লেওবা বা লবা প্যাটেলদের নিয়ে। এদের মধ্যে কদবারা নিজেদের রামপুত্র কুশের বংশধর বলে দাবি করেন।মূলত হিরে-জহরত,রিয়াল এস্টেট আর বস্ত্র শিল্পের নিয়ন্ত্রণ এদের হাতে। এদের বর্তমান প্রজন্ম ব্যবসা বিমুখ। ২০০৮ পরবর্তী মন্দা এদের ব্যবসায় আরও ধ্বস নামায়।সম্পদের ঐতিহ্য হারানো আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়ানো কদবারাই হার্দিকের প্রধান সমর্থক। লেবা বা লবা প্যাটেলদেরও সংকট আছে।আর সেটাও রুজি-রুটিরই। রামের আরেক পুত্র লব না কি এদের পূর্বপুরুষ। কচ্ছ, মেহসানা ও খেড়ায় বড় জমির জোত, কো-অপারেটিভের নিয়ন্ত্রণ এদের হাতে। কৃষি ক্ষেত্রের সংকট তো ছিলই। নোট বাতিলের জেরে নগদ সংকটে এরা জমিতে ক্ষেত মজুর নামাতে পারেনি। কো-অপারেটিভের কাজও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু, লেবারা তাতেও দল বেঁধে মোদি বিরোধী হয়ে যাননি। এদের অন্য অংশ প্লাস্টিক , রাসায়নিক ও ওষুধ শিল্প চালায়। তারা আবার মোটের ওপর বিজেপিকে নিয়ে খুশি।
আসলে বল্লভভাই প্যাটেল নিজে যে জাতের মুখ, তারা এই মুহুর্তে মোদির উপর রাগের থেকে বেশি অভিমান করেছেন। সেটাও আপাদমস্তক সব প্যাটেলরা নন। আর এখানেই মোদির জন্য রূপোলি রেখা থাকছে। মোদি বরাবর ‘গুজরাতি অস্মিতা’র সূত্রে সর্দার প্যাটেলের উত্তরাধিকার দাবি করেছেন। প্যাটেলরা তাকে সেই আসনটি হাসি মুখেই দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী থেকে ঘরের ছেলে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই ‘আত্মীয়তা’য় আগের মত আন্তরিকতা টান দেখতে পাচ্ছেন না প্যাটেলদের একাংশ। মোদি যদি সেই অভিমান ভোলাতে পারেন তাহলে তো কথাই নেই। না পারলেও, শেষ রাউন্ডে তার উতরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ, সংসদীয় গনতন্ত্র সংখ্যার খেলা। আর সংখ্যার বিচারে সব প্যাটেল মোদির বিরুদ্ধে নন।
অনির্বাণ সিনহা
( লেখার বিষয়বস্তু, মতামত ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব)