আজ পঁচিশে বৈশাখ! সারা বছরের দিন-যাপনে শয়নে, স্বপনে, জাগরণে যতই রবিঠাকুর রবিঠাকুর চলুক না কেন| আজকের দিনটা স্পেশাল| আপনজনের জন্মদিনে যেমন তাঁকে নিয়ে একটু বেশি হই চই করতে ভাল লাগে, উচ্চারণ করে হ্যাপ্পি বার্থডে বলতে ভাল লাগে, এও অনেকটা সেরকম| করোনা আবহের ভারচুয়াল সেলিব্রেশন অবশ্য শুরু হয়ে গিয়েছে রাত থেকেই। ফেসবুকে আর হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপগুলোতে গান, কবিতা, নাচের ক্লিপিংস ভিড় করে আসছে একের পর এক।
কিন্তু এতো ভিড়ের মধ্যেও একটা প্রশ্ন ধাক্কা দিতে থাকে। পরের প্রজন্মের মধ্যেও বইবে তো এই গানের তরী? আজকের নার্সারি রাইম, অনলাইন ভিডিও গেম আর গ্যাজেট-শাসিত ছোটোবেলার কি ইচ্ছে করে 'কানাই মাস্টার' হয়ে আদরের 'বেড়াল ছানা'টিকে পড়াতে? কোথাও কী আছে সেই 'বীর পুরুষ' কিম্বা মায়ের সঙ্গে 'লুকোচুরি'তে মেতে থাকা সেই ছোট্ট 'খোকা'? হাজার পড়ার ফাঁকে এই প্রজন্ম কী 'প্রশ্ন' করে, "একদিনও কি দুপুরবেলা হলে, বিকেল হল মনে করতে নাই?"
'ফুল-ঘাস-পাতা-হাতি-ঘোড়া' ভাল লাগে না বছর বারোর মিতির। গল্পের বইয়ের তাক শাসন করছে মূলত 'থ্রিলার' আর 'ডিটেকটিভ স্টোরিজ'। অথচ পাঠ ভবনে পড়া মিতি ওরফে শ্রুবা দত্তাচার্যের মনে দাগ কেটেছে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের লেখা 'দীন দান' কবিতাটি। ক্লাস এইটে পড়া, টিন-এজ ছুই ছুই মেয়ের কথায়, "সে মন্দিরে দেব নাই, কহে সাধু-- এই লাইনটা কোথাও যেন এখনকার সময়েও খুব সত্যি।"
গাইতে বললে রবীন্দ্রনাথ বেছে নেওয়া মিতির অবশ্য স্পষ্ট বক্তব্য, "আজকের আশেপাশের পরিবেশ আর কবি যে সময়ে, যে পরিবেশে তাঁর গান রচনা করেছেন, দুইতে অনেক ফারাক। তাই ঋতু পর্যায়ের বেশ কিছু গান রিলেট করতে অসুবিধা হয়।" তবুও মেয়ের গলায় বয়ে যায়, 'মাধবীলতার দিশাহারা ব্যাকুলতা'! কারণ, স্কুলে এবং বাড়িতে বাংলা নাচ-গান-কবিতার পারিপার্শ্বিক নিয়ে বেড়ে ওঠা মিতির এটাও মনে হয়, "ওঁর চোখ দিয়ে প্রকৃতির এক অন্য চেহারাও কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় এই গানগুলোতে!" আর এভাবেই চৈত্র দুপুরে কখনও কখনও অনলাইন ক্লাস সেরে 'বিপুল তরঙ্গে' ভেসে যায় হঠাৎ বড় হয়ে ওঠা মিতি।
বছর আড়াইয়ের সাকিনের মুখে এখনও কথা স্পষ্ট হয়নি। সেই আধো উচ্চারণেই "ভালবেসে সখী নিভৃত যতনে" গায় ওই কচি মুখ! খুব সহজ-সুন্দর শোনালেও প্রশ্ন আসে আজকের পারিপার্শ্বিকে কীভাবে সম্ভব? ঝটপট উত্তর মা পল্লবী বন্দ্যোপাধ্যাযের, "সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ঘুম-পাড়ানি গান হোক বা ছড়া, ছোটবেলার দিনগুলোতে 'বাংলা আবহে' বড় হোক সাকিন। আর সেই সিদ্ধান্তে মত দিয়েছিলেন সাকিনের বাবা, সুজয় বাগ ও পরিবারের সকলে।
তাই 'বুলবুল পাখি ময়না-টিয়ে', 'চুপ চুপ লক্ষ্মীটি'র পাশাপাশি 'ফুলে-ফুলে ঢোলে ঢোলে', 'আমার পরান যাহা চায়' শুনেই বড় হচ্ছে সাকিন যার ভাল নাম, আনমন অরণ্য। এমনকি গান শোনার সময় 'যখন এসেছিলে অন্ধকারে চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে...' ও বেছে নেয় পুচকে ছেলে।
পল্লবীর কথায়, "নাহ্ পারিপার্শ্বের ওপর আস্থা রাখিনি আমি। আমি নিজেই ঠিক করে নিয়েছি কী শুনিয়ে ওকে বড় করব। যাতে ও নিজে পছন্দ করে নেওয়ার বয়সে পৌঁছে গেলেও কোথাও একটা রবীন্দ্রনাথ-নজরুল বাংলা গান-কবিতা শোনার খিদেটা থাকে। পেশাগতভাবে একটি ওয়েব ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত থাকা পল্লবীর স্পষ্ট কথা, "দায়িত্বটা মায়েদের। বাবাদেরও। বাচ্চাকে যা শুনিয়ে বড় করা হবে সে সেটাই শুনবে এবং শিখবে। তাকে যদি মা 'হানি সিং' শুনিয়ে বড় করেন তবে সে সেটাই শিখবে এবং গাইবে। তাই শিশু মনে কীসের প্রভাব কতটা দিতে চান তা নিজেকেই ঠিক করতে হবে।" পল্লবীর মত, পরবর্তী প্রজন্ম রবীন্দ্রসংগীত শুনুক এমন চাইলে মাকে কিন্তু গোড়া থেকেই চাষ করতে হবে রবীন্দ্র ভাবনার, তৈরি করে দিতে হবে পরিবেশ। ওর কথা মনে করিয়ে দিল আজ মাদার্স ডে|
মর্ডান হাইয়ের উৎসার অন্যতম ফেভরিট হল কোরিয়ান ব্যান্ড 'বি টি এস'। তবু সুন্দর করে সেজেগুজে বসে দিব্বি গড়গড়িয়ে "তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে" রেকর্ড করেছে ক্লাস থ্রি এর মেয়েটি। রবিঠাকুরের জন্মদিনের ভারচুয়াল অনুষ্ঠানের জন্য গানও গেয়েছে| উৎসার মা শ্রীমন্তী অবশ্য ওকে সারাবছরই গান, নাচ, কবিতার চর্চার মধ্যেই রেখেছেন| করোনা অতিমারী, দীর্ঘ লকডাউনের ঘরোয়া অবসরে বেশ বেড়েছে সেই চর্চা।
পেশায় অধ্যাপিকা শ্রীমন্তীর কথায়, "আসলে আদান-প্রদানটা খুব জরুরি। আমি ওর কাছ থেকে ওর পছন্দের ব্যান্ডের গল্প শুনি। আবার ও শোনে আমাদের শান্তিনিকেতনের গল্প।" আরও একটা বিষয়ে জোর দেয় শ্রীমন্তী। "বইয়ের প্যাকেজিং-গুলো আরেকটু চকচকে হলে হয়ত এই প্রজন্মের বাচ্চাদের ভাল লাগবে আরও বেশি। পুরনো বইগুলোর সঙ্গে হয়ত আমাদের অনেক নস্ট্যালজিয়া কাজ করে। ওদের তো ওগুলো নেই। তাই ওদের কাছে আরেকটু আকর্ষণীয় করে তোলা যায় কিনা সে নিয়েও ভাবনা-চিন্তা করাটাও কিন্তু দরকার।"
উৎসা, সাকিন, মিতিদের গল্প শুনে ভরসা জাগে। এই প্রজন্মেও যেন কোথাও একটা চোরা স্রোত বয়ে চলেছে সকলের অলক্ষে। সংখ্যায় অল্প হলেও ওরাই বিশ্বাস জোগায়। এই রবি-ধারা বয়ে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। গ্যাজেটের ভিড়েও জায়গা করে নেবে রবি-গান। তবে "ওরা রবীন্দ্রনাথে 'রিলেট' করতে পারে না" বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না। দায়িত্ব নিতে হবে মা-বাবাদের। নাহলে হয়তো বছরে দু'বার 'শ্যামা-সাপমোচনেই' আটকে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। আর বাংলা ও বাঙালির 'সংস্কৃতির ধারা' বয়ে নিয়ে যাওয়ার, দৌড়ের শেষে ব্যাটন-টা ধরার, হয়ত একদিন আর কেউ থাকবে।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Rabindra Jayanti