# কলকাতা : দিন সাতেক আগের কথা। লকডাউনে স্রেফ সময় কাটাতে নিজের বছর দুইয়ের ভাগ্নের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলেন অভিষেক মণ্ডল। কথা বলতে বলতেই মাথায় খেলে যায় কিছু একটা করার। অবশ্যই ছোটদের নিয়ে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। শুরু হল কচিকাঁচাদের খোঁজার পালা।
শুরু হল ফোনের পালা। নিজের পরিচিতদের কাছ থেকে খুদে সন্তান রয়েছে এমন অভিভাবকদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহের কাজ শুরু করলেন অভিষেক। এরপর একে একে শুরু হল সেই সমস্ত নম্বরে ফোন করা। প্রস্তাব শুনে তাঁদের কাছ থেকে সারাও পেলেন যথেষ্ট। কলকাতা, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, আসানসোল , সিউড়ি ও শিলিগুড়ি থেকে সাতাশ জন খুদের সন্ধান মিলল। অভিভাবকদের দ্বারা মোবাইল ফোনে করোনা সচেতনতামূলক বিভিন্ন বার্তা সহ নানান সাংস্কৃতিক পরিবেশনের অডিও ভিডিও ক্লিপ একত্রিত করে তিন দিনের প্রচেষ্টায় অভিষেক নির্মাণ করে ফেললেন তাঁর লকডাউন ভাবনার ছবি ' চিল্ড্রেন অফ হোপ'। যা সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ইউটিউব চ্যানেলে। এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের ব্যতিক্রমী ভাবনার সিনেমা বানাতে কলকাতার বাঘাযতীনের বাসিন্দা তরুণ চিত্র পরিচালক অভিষেক মণ্ডলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছোটদের নিয়ে এই সিনেমার ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে সিনেমায় ভাষ্যপাঠ ও সেইসঙ্গে অভিষেকের সাথে নিরলস লড়াই করে গেছেন শহরেরই আরও এক সহনাগরিক সল্টলেকের বাসিন্দা কৌশানি কুণ্ডু৷
লকডাউনের কারণে বাইরে বেরোনো নিষেধ। তাই গোটা প্রক্রিয়াটাই সম্পন্ন হয়েছে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে। পরিচালক অভিষেকের কথায়,' এখন গোটা দেশ-জুড়ে চলছে লকডাউন। কলকাতা তথা আমাদের রাজ্যও ব্যতিক্রম নয় । আমরা তো নিজেদের মতোন করে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত আছি। কিন্তু একবারও কী ভেবে দেখেছি কখনও যে, আমাদের ঘরের গৃহ-বন্দী ছোট্ট শিশুদের সময়গুলো কাটছে কেমন করে ? ওরা কতোটা মন খারাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ? খেলার মাঠ বা পার্ক ওদের কীভাবে ডাকছে ? কখনও কী জানতে চেয়েছি আমরা ? কী ভাবছেন, বন্দী-দশায় থেকে ওরা হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে গেছে। তাহলে বলবো আপনি ভুল ভাবছেন'। ছোটদের কাছ থেকেই তো শিখতে হয়, যে, এই মন-খারাপের দিনগুলোকে এক তুরিতে উড়িয়ে দিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকার রসদ জোগার করতে হয়। ওদের আদো-আদো গলায় আবৃতি, গান আর নাচের উল্লাসের গুঁতোয় এই বন্দী-দশাকে স্রেফ বুড়ো-আঙুল দেখিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, তারই একটা রসদের সন্ধানের পাশাপাশি সচেতনতার পাঠ দেওয়া হয়েছে এই সিনেমা থেকে। বললেন অভিষেক।
সিনেমা তৈরির দুই কারিগরের মধ্যে অন্যতম কৌশানি বললেন, এই শিশুরাই তো আমাদের ভবিষ্যত। লকডাউন চলাকালীন আমাদের উচিত ঘরের মধ্যেই খেলাধুলা ও বিভিন্ন শিক্ষামৃলক কাজকর্মের মধ্য দিয়ে তাদের আরও উৎসাহ দেওয়া। যাতে ওরা বর্তমান সময়ে কোনও ভাবেই মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে না পড়ে। তাই স্রেফ ছোটদের কথা ভেবেই আমাদের এই সিনেমা তৈরির ভাবনা'। অভিভাবকরাও খুশি তাঁদের সন্তানদের নানান মুহূর্ত নিয়ে ছবি তৈরির মাধ্যমে লকডাউনে একদিকে ঘরে থেকে সুস্থ থাকার বার্তা। আর অন্যদিকে ঘরবন্দি থাকা শিশুদের কিছুটা আনন্দ দেওয়ার অভিনব উদ্যোগে। অনুষ্কা, অনুরাগ, সায়নদীপ, দেবাদৃতা, অঙ্কিতার মত সব ছোট ছোট অভিনেতা অভিনেত্রীরা দীর্ঘদিন ঘরবন্দি হয়ে থাকায় মনখারাপের মধ্যেও যে সচেতনতার বার্তা দিয়ে যেভাবে সিনেমা তৈরিতে সামিল হল তাকে কুর্ণিশ জানাতেই হয়। অভিভাবকদের মধ্যে সৌমিতা পাল, সন্দীপ দাসরা বললেন, গত কয়েকদিন ধরে সন্তানদের যে কীভাবে ঘরবন্দি করে রেখেছি তা আমরাই জানি। ওদের মন ভাল রাখার পাশাপাশি সমাজকে সিনেমার মাধ্যমে সচেতন করার প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বর্তমান কঠিন সময়ে সবার উচিত এই সিনেমাটি দেখা'। তবে সিনেমা তৈরির প্রধান দুই কারিগর সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করা এবং রাজ্য তথা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন তথ্য চিত্রের সম্পাদনা করা অভিষেক কিম্বা ড্রামা এন্ড থিয়েটার আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করা কৌশানির বক্তব্য, ' যেভাবে লকডাউন মেনে ঘরে বসে আধুনিক প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে এই সিনেমা তৈরি হয়েছে তা জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। আলাদা অনুভূতি'। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় লকডাউনই একমাত্র পথ। কিন্তু অনেকেই আজ তা উপেক্ষা করে রাস্তায় নামছেন। যা অত্যন্ত বিপজ্জনক। সরকারিভাবে নানান প্রচার নির্দেশিকা জারি করলেও অনেকেই আজ বেপরোয়া। সাম্প্রতিককালে লকডাউন মেনে ঘরে থাকার বার্তা দিয়ে অমিতাভ বচ্চন সহ একাধিক নামজাদা তারকারা তৈরি করেছেন সিনেমা 'ফ্যামিলি'।
অন্যদিকে এ রাজ্যের টলি তারকারা সেই একই বার্তা নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যের সিনেমা 'ঝড় থেমে যাবে একদিন' আজ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনপ্রিয়। এবার সেই একই বার্তা নিয়ে শিশুদের সামনে রেখে অন্য স্বাদের সিনেমা 'চিল্ড্রেন ফর হোপ' তৈরি করলেন কলকাতার সচেতন দুই নাগরিক অভিষেক আর কৌশানি। গৃহবন্দী জীবনে ছোটরা কতটা মনখারাপে আছে? কতটা ডাকছে তাদের খেলার মাঠ? জানতে চেয়েছি কখনও আমরা? দুঃখ পেয়ে ওরা কী হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে? না না , একটুও নয়। ওদের থেকেই তো শিখতে হয় মন খারাপকে ধুলোয় উড়িয়ে কেমন ভাবে বাঁচতে হয়। কবিতায়, গানে আনন্দ-উল্লাসে দিব্যি বন্দিজীবনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সাহস করে দিন কাটাচ্ছে ওরা। এই সিনেমার মাধ্যমে লকডাউন মেনে চলার আর্জি জানিয়ে বড়দেরকে সাহস যুগিয়ে, আশার আলো দেখিয়ে খুদেরা বলছে, ' ঘরে থাকো দিন রাত। কোরোনা হবে কুপোকাৎ'। ছোটদের এই আর্জির পরেও লকডাউন মানার প্রশ্নে আদৌ সচেতন হবেন নাগরিকরা ? উত্তর দেবে সময়ই।
VENKATESWAR LAHIRI
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।