COVID19–এর কারণে বিশ্ব এক অভূতপূর্ব সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধটি লেখার সময় (১৬ এপ্রিল, ২০২০) ছ’টি মহাদেশের ১৪৬টিরও বেশি দেশে প্রভাবিত হয়েছে করোনায়। মৃত্যু হয়েছে ১৪৬,৮৭৯–রও বেশি মানুষের। পাঁচটি সবচেয়ে উন্নত দেশে (ইতালি– ২২,১৮০, আমেরিকা – ৩৪,৫৬২, স্পেন–১৯,৫১৬, ফ্রান্স–১৭,৯২০; ব্রিটেন= ১৩,৭২৯ মোট– ৭০,৬১১) মোট মৃত্যুর সংখ্যার ৭৩%–এরও বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এই দেশগুলির কয়েকটি, তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে বলে এই পরিসংখ্যান আরও অবাক করে তুলেছে। তাহলে কী মহামারীর সময়ে সর্বোত্তম যত্নের ব্যবস্থা থাকলেও আপনি সুরক্ষিত নন? তাহলে আর কী আমাদের রক্ষা করতে পারে? কিছু দেশ কেন এত ভাল করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করল আর অন্যরা এখনও লড়াই করেছে?
এই সময়ে যে দেশগুলি যথাযথভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে, তারা হল, অস্ট্রেলিয়া (সংক্রামিত = ৬৪১৬, মৃত্যু = ৬১; প্রতি মিলিয়নে/ ২ জনের মৃত্যু) সিঙ্গাপুর (সংক্রামিত = ৩২৫২, মৃত্যু = ১০, প্রতি মিলিয়নে/ ১ জনের মৃত্যু), দক্ষিণ কোরিয়া (সংক্রামিত = ১০৫৯১, মৃত্যু = ২২৫, প্রতি মিলিয়নে/ ৪ জনের মৃত্যু), জার্মানি (সংক্রামিত = ১১৮২৩৫, মৃত্যু = ২৬০৭, প্রতি মিলিয়নে/ ৩১ জনের মৃত্যু), কানাডা (আক্রান্ত = ২৬১৪৬, মৃত্যু = ৮২৩ প্রতি মিলিয়নে/ ১৩ জনের মৃত্যু) এবং ভারত (সংক্রামিত = ১১৪৩৯, মৃত্যু = ৩৭৭, প্রতি মিলিয়নে/ ০.২ জনের মৃত্যু)
(উৎস: https://covid19.who.int/, 16/04/2010 এ দুপুর ২ তথ্য)।
এই সাফল্যের জন্য উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, একটি দেশের দূরত্ব, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং নেতৃত্বের জন্য বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছে সংবাদমাধ্যম। যে কেউ বলতে পারে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা মোকাবিলায় একটি দেশের শক্তিশালী প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে পারে এবং মৃত্যু রোধ করার ক্ষমতা রাখে। আমরা বিশ্বাস করি যে, স্বাস্থ্যসেবা নির্দিষ্ট নিয়মগুলি কেবল পরিস্থিতির অর্ধেকটাই ব্যাখ্যা করতে পারে। উদাহরণ? স্বাস্থ্য পরিষেবার তালিকায় ক্ষেত্রে ভারত বাদে সব এই দেশই শীর্ষ ৫০ জনের মধ্যে রয়েছে। ১১৮ তম স্থানে রয়েছে ভারত। আর সেই দেশই অনেক ভাল করে করোনা প্রতিরোধ করছে।
একটি দেশের সবচেয়ে ভাল পদক্ষেপের ব্যাখ্যা করা যায় দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পদক্ষেপ বিচার করে। যে দেশগুলি ভাল অবস্থায় আছে, সেগুলির প্রত্যেকের নেতারা তাদের দেশগুলিকে মহামারী থেকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। কী এমন করেছে তাঁরা? কী শিখতে পারি আমরা তাঁদের থেকে?
সিঙ্গাপুর
জনসংখ্যা এবং ভৌগলিক দিক থেকে সিঙ্গাপুর তুলনামূলকভাবে ছোট একটি দেশ। এটি এর আগে SARS–এর সঙ্গে লড়াই করেছে। তাই COVID-19 সামলাতে তাঁরা প্রথম থেকেই জানাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রস্তুত ছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী দ্রুত সাড়া দিয়েছিলেন। আমরা সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচটি বিষয় শিখতে পারি।
১. দ্রুত ব্যবস্থা - সিঙ্গাপুর অন্যান্য অনেক দেশের (১ ফেব্রুয়ারী) আগে তার নাগরিকদের ভালভাবে রক্ষার জন্য একটি জাতীয় পরিকল্পনা নিয়েছিল। ২. সংখ্যায় প্রচুর পরীক্ষা করুন এবং যত দ্রুত সম্ভব করোনা পজিটিভদের শনাক্ত করুন। ৩. পজিটিভি রোগীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখুন। ই মনিটারিং চালান তাঁদের ওপর। নিয়ম না মানলে কঠোর জরিমানা করা। বিদেশী কর্মীরা যদি বিধি লঙ্ঘন করেন, তাঁদের নির্বাসন দেওয়া। যদি কাউকে আইসোলেশন বিধি লঙ্ঘন করতে দেখা যায় তবে কঠোর শাস্তি দেওয়া। ৪. বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের মাধ্যমে করোনা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা। ৫. নাগরিকরা তখনই তাদের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে যেতে পারেন সে জন্য ব্যাপকভাবে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।
কানাডা
কানাডার সাফল্যকে কী ব্যাখ্যা করতে পারে? কানাডা কী আলাদা করেছে? দেখুন
১. একটি সমন্বিত পদ্ধতি ছিল এবং কানাডার সমস্ত প্রদেশ জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিয়মিতভাবে সাংবাদিক বৈঠকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য কর্মীদের পরামর্শ অনুসরণ করে চলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২. কানাডার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী, কারণ সমস্ত কানাডিয়ান কোনও খরচ বা বীমা ছাড়াই স্বাস্থ্য সেবা পান। ৩. কানাডা সম্পূর্ণরূপে এই ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য ১১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এবং কোভিড ১৯–এর সাথে লড়াইয়ের জন্য স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পরিকাঠামো আরও শক্তিশালী করবেন তাঁরা।
জার্মানি
প্রতিবেশী দেশগুলির তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম রাখতে পেরেছে জার্মানি। অ্যাঞ্জেলা মর্কেলের নেতৃত্বের কারণেই সেটা সম্ভব বয়েছে।
১. জার্মানি কোরনার জন্য ব্যাপক হারে পরীক্ষা করেছে। গড়ে সাপ্তাহিক ৫ লক্ষ পরীক্ষা করেছে এবং তাড়াতাড়ি পজিটিভ কেস শনাক্ত করেছে। ২. জার্মানি সমস্ত ক্ষেত্রের বাণিজ্য রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন স্কিম চালু করে। এগুলি এমন সমস্ত বাণিজ্যের জন্য অর্থ সরবরাহ করেছে যা মহামারীর কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। ৩. জার্মানি খুব তাড়াতাড়ি লকডাউনের শর্ত আরোপ করেছিল। যখন দেশে নিহতের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৪ জন। বিপরীতে, স্পেনে ১৯১ জন, আমেরিকায় ৪২২ এবং ৪৩৩ জন মারা যাওয়ার লকডাউন ডাকা হয়।
দক্ষিণ কোরিয়া
দক্ষিণ কোরিয়া কী করে এত সহজে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নিল?
১. মহামারী রুখতে বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নেতৃত্ব দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছিল। ২. দক্ষিণ কোরিয়া COVID-19–এর জন্য ব্যাপকভাবে পরীক্ষা করেছে। ৩. সন্দেহভাজন সদস্যদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য যোগাযোগের ইতিহাস খুঁজে বের করা এবং দ্রুত পদক্ষেপ করার জন্য জিও-ট্র্যাকিং এবং সিসিটিভির ব্যবহার করা হয়েছিল। ৪. জাতীয় প্রচেষ্টা। দক্ষিণ কোরিয়া একটি সু-সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। ৫. এছাড়াও আর্থির সহায়তা সহ আরও বেশ কয়েকটি বিষয় তো রয়েছেই।
অস্ট্রেলিয়া
দেখে নিন, অস্ট্রেলিয়া ঠিক কী কী ব্যবস্থা নিয়েছিল
১. নিজস্ব প্রদেশগুলিকে নিজেদের মতো করে করোনা নিয়ে সতর্কতা নিতে বলেছিল অস্ট্রেলিয়া। স্বাস্থ্যকর্মীদেরও নিজের মতো করে সুরক্ষা ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল ২. বিদেশি পর্যটকদের বিষয়ে কড়া নিয়ম। তাঁরা যাতে সহজে যেতে আসতে না পারে, আর যাঁরা এসেছেন তাঁরা যেন ১৫ দিনের কোয়ারেন্টাইনে থাকেন। ৩. সহজে করোনা টেস্ট করার ব্যবস্থা করা। ৪. সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও আইসোলেশনের কঠোর নিয়ম লাগু করা। খুব কম সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মানুষেরা সরকারে সেই নিয়ম মেনেও চলেছেন। ৫. বাণিজ্যিক ক্ষেত্র সামাল দিতে অস্ট্রেলিয়া একাধিক আর্থির প্যাকেজও ঘোষণা করেছে সময় মতো। ৬. ২.৪ বিলিয়ন অর্থ অস্ট্রেলিয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে খরচ করেছে অস্ট্রেলিয়া।
ভারত
ভারত এদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল কাজ করেছে করোনা মোকাবিলায়। কীভাবে, দেখে নিন।
১. বিদেশিদের আগমের বিষয়ে ভারত কড়া হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই করোনা আক্রান্ত দেশগুলি যেমন চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান থেকে আগতদের ১৫ দিনের আইসোলেশনে থাকার নির্দেশ। ১৮ মার্চ থেকে পৃথিবীর সমস্ত দেশের ক্ষেত্রে এই নিয়ম। ২. লকডাউন। ঠিক সময় মতো দেশে লকডাউন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি দেশের নাগরিকদের এই লকডাউনের সময়ে মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখারও ব্যবস্থা করেছেন তিনি। ৩. ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আলাদা আলাদা দল দ্বারা শাসিত হলেও তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেছে। ৪. কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের বিষয়ে ভারত কঠোর নিয়ম পালন করেছেন। এবং আরোগ্য সেতুর মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে করোনাকে আটকে দিতে চেয়েছে। ৫. নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েছে। কখনও ম্যালেরিয়া, সোয়াইন ফ্লু বা কখনও HIV–এর ওষুধ ব্যবহার করেছে রোগ প্রতিরোধে। ৬. অর্থনৈতিক প্য়াকেজ ঘোষণা করেছে সময়মতো। গরিবমানুষের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছে দিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা করেছে। ৭. সার্কের দেশগুলির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। জি২০ দেশগুলির সঙ্গে আলোচনা করেও একই সঙ্গে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক দিয়ে শক্তিশালী অবস্থানে গিয়েছে ভারত। ৮. অনেকেই অভিযোগ করেছেন ভারত বড্ড তাড়াতাড়ি লকডাউনে গিয়েছে। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, এত তাড়াতাড়ি না গেলে হয়ত দেশের অসুবিধা আরও বাড়ত। সব ব্যবস্থা করাও সম্ভব হত না। স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হত।
অধ্যাপক মিলিন্দ সত্যার একটি প্রবন্ধ থেকে এই পরিসংখ্যান গৃহীত।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Coronavirus, India, Lockdown