হোম /খবর /কলকাতা /
মড়কে শ্মশান হয়েছে বাংলা, ইতিহাসেই রয়েছে লড়াইয়ের মন্ত্র

মড়কে শ্মশান হয়েছে বাংলা, ইতিহাসেই রয়েছে লড়াইয়ের মন্ত্র

১৮৯৭ ,সাল। চলছে প্লেগ রোগীর চিকিৎসা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

১৮৯৭ ,সাল। চলছে প্লেগ রোগীর চিকিৎসা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

গভীর অসুখের এই আবহে মনে পড়ে যাচ্ছে সত্যেন দত্ত: 'মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি, বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশিষে অমৃতের টীকা পরি।' লিখছেন- অর্ক দেব।

  • Last Updated :
  • Share this:

"ইন্দ্র বলিল, মড়া! আজকাল ভয়ানক কলেরা হচ্ছে কিনা! সবাই তো পোড়াতে পারে না...মুখে একটুখানি আগুন ছুঁইয়ে ফেলে রেখে যায়। শিয়াল কুকুরে খায় আর পচে।"

বাংলা সাহিত্যের পাঠকমাত্রেই জানেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রণীত 'শ্রীকান্ত'-র উদ্ধৃতি। বলা কওয়া নেই হঠাৎ একটা সংক্রমণ এসে আজ যখন ঘরবন্দি করে রেখেছে, তখন সাহিত্যের পাতায় চোখ রেখে, সামান্য ইতিহাস বারবার মনে হচ্ছে ঘেঁটে মনে হচ্ছে, পাশ্চাত্যের বহু দেশ এই মারীকে নতুন করে দেখলেও এসব আমাদের গা সওয়া, উত্তরাধিকার বলেই আমাদের আপত্তিটা শুধুই ঘরে থাকায়। আমাদের পোড়া বঙ্গদেশে নানাদশকে দশকে গাঁ উজার করে দিয়েছে মারী। শিল্পসাহিত্যের পাতায় পাতায় সেই রক্তদাগ আজও অক্ষয়। করোনা যতই ভয় দেখাক, আমাদের অতীতই আমাদের হয়ে সওয়াল করতে পারে। গভীর অসুখের এই আবহে মনে পড়ে যাচ্ছে সত্যেন দত্ত: 'মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি, বাঁচিয়া গিয়েছি বিধির আশিষে অমৃতের টীকা পরি।'

হ্যাঁ, বিধির আশীর্বাদই বটে। দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর 'শরীর সমাজ ও রাষ্ট্র: ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারী ও জনসংস্কৃতি' প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, একেকটা ভয়াল মহামারী লক্ষ মানুষের প্রাণ নিয়েছে। সরকার বাহাদুর তাঁর বাহিনীর শরীর বাঁচাতেই ভারতীয় শরীরে সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টায় নেমেছে, আর মানুষ 'সুঁই নিতে দ্বিধা কাটাতে না পেরে বরং ধর্মের, লোকাচারের দ্বারস্থ হয়েছে। দেড় শতক পার করে এই করোনা রোগীর ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া, প্রদীপ জ্বালিয়ে শক্তি জাগ্রত করার অবৈজ্ঞানিক 'ভারতীয়ত্ব' দেখে সেদিনের কথাই মনে পড়ছে। ইতিহাসই বলছে, সময় গিয়েছে। সাবালক হইনি আমরা।

উনিশ শতকের অস্থায়ী প্লেগ হাসপাতাল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স উনিশ শতকের অস্থায়ী প্লেগ হাসপাতাল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

সেদিনের মতোই আজ গুজব আমাদের বিপদের বন্ধু। শুধু মাধ্যমটা বদলে গিয়েছে। সে দিনও সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই না করে, কেউ বলেছিল মক্কায় হজ রুখতে ব্রিটিশ রোগ ছড়াচ্ছে, কেউ আবার বলেছিল সাম্রাজ্যবিস্তারের লোভে কালীর পায়ে রক্ত দিয়ে নরমেধযজ্ঞ সারছে ব্রিটিশ। আর এই সবের মাঝেই ঝরে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ ছেলেবুড়োর প্রাণ

বাংলায় প্রথম প্লেগ হানা দেয় ১৮৯৮ সালে। কলকাতা, হুগলি, চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, মেদিনীপুর , রাজশাহীতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে রোগ। মূলত নিকাশী ব্যবস্থার বেহাল দশা , আর গুদামজাতে শস্যের লোভেঘরে ঢুকে পড়া ইঁদুর। মিউনিসিপালিটির প্লেগ রিপোর্টে দেখছি, ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলায় প্রথম প্লেগে মৃত্যু হয়। কাপালিটোলা লেনের এক বাসিন্দার দেহ ময়নাতদন্ত করে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্তে আসেন- প্লেগেই মৃত্যু। ঝড়ের বেগে সংক্রমণ ছড়ায় বেনিয়াপুকুর, বড়বাজার, কুমারটুলি, শ্যমপুকুরে। ৩০ এপ্রিল প্রশাসন বাধ্যত জানায়, কলকাতায় প্লেগ মহামারীর আকার ধারণ করেছে।

'রিপোর্ট অন প্লেগ ইন ক্যালকাটা'-এ প্রকাশ, প্লেগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল বড়বাজার, জোড় বাগান অঞ্চল। সেই সময়ের স্যানিটাইজেশন কমিশনার ডব্লিউ ডব্লিউ ক্লেমেসা প্লেগ পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত লেখালেখি করেছেন। 'বাংলার প্লেগ পরিস্থিতি' শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন,প্লেগ গ্রামবাংলার খুব বেশি ক্ষতি করেনি। গুদামজাত পণ্য থেকে রোগ ছড়িয়ে পড়ে শহরাঞ্চলে। প্লেগে মৃত্যুহার ছিল মারাত্মক। সংক্রমিতদের ৯০ শতাংশকেই বাঁচানো যায়নি। নীচের ছবিতে দেখানো হল প্লেগ সংক্রমিত এলাকায় মৃত্যুর হার। তথ্যসূত্র:রিপোর্ট অন প্লেগ ইন ক্যালকাটা।

প্লেগ যখন শহর খালি করছে তখন গোটা বাংলাতেই দাঁত নখ বের করেছে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর। ম্যালেরিয়ার শুরুয়াত অবশ্য আনুমানিক ১৮৬১তে। এই রোগ মারীর আক্রমণ করে ১৮৮০ সালে। শুরুর দিকে ম্যালরিয়া বর্ধমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করায় একে বর্ধমান জ্বর বলে চিনত লোকে। প্রতি বছরই ম্যালেরিয়ায় কয়েক লক্ষ লোক মারা যেত। ম্যালেরিয়ার দাপট ছিল উত্তরবঙ্গেও। ১৮৫০ থেকেই দার্জিলিং-সহ তরাই ডুয়ার্সে জঙ্গল কেটে চা বাগান গড়া শুরু করে ব্রিটিশ সাহেবরা। ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ। লেডি ক্যানিং ১৮৬৬ সালে দার্জিলিং যাওয়ার সময় এই জ্বরের প্রকোপে পড়েন। জীবদ্দশায় তাঁর জ্বর সারেনি। ১৯২১ সালের জনগণণার রিপোর্ট বলছে বাংলায় ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হয়েছে ৪ লক্ষ ৯৪ হাজার ৪৭৩ জনের। এই রিপোর্ট নিয়ে 'ফ্রিলান্সার' পত্রিকায় সন্দেহ প্রকাশ করেন নৃপেন্দ্রকুমার বসু। তাঁর অনুমান ছিল, সরকার মৃত্যু হার লুকোচ্ছে। কবিতা রায়ের হিস্ট্রি অফ পাবলিক হেল্থ গ্রন্থে বিশদে তুলে ধরা আছে ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর হিসেবনিকেশ। সে দিকে চোখ রাখা যাক-

  • ১৯২১- ৭ লক্ষ ৩৭ হাজার ২২৩ জন
  • ১৯২৯- ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার ৪১৪ জন
  • ১৯৩৮- ৪ লক্ষ ১৬ হাজার ৫২১ জন।
  • ১৯৪৪- ৭ লক্ষ ৬৩ হাজার ২২০ জন

এই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ নিয়ে লেখালেখির শেষ নেই,শেষ নেই বিপনন ও উদ্ভাবনেরও। আয়ুর্বেদ নবজাগরণ, চায়ের বিপননের ইতিহাসের সঙ্গে ওতোপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে এই রোগ। বলা যায়, জনজীবনের সঙ্গেই ম্যালেরিয়ার সম্বৎসরের বোঝাপড়া ছিল।

সেই সময়ের জনপ্রিয় ম্যালেরিয়ার ওষুধের বিজ্ঞাপন। সেই সময়ের জনপ্রিয় ম্যালেরিয়ার ওষুধের বিজ্ঞাপন।

অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া মনে পড়ছে- "জাপানীরা ভাগল কেন, খবরটা কি রাখেন? কেশনগরের মশার মামা. ইম্ফলেতে থাকেন।" রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: "ম্যালেরিয়া রোগটা ভাল জিনিষ নয়— ওর সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধ পাতিয়ে শ্ৰীমতী ম্যালেরিয়াকে অর্ধাঙ্গিনী করবার চেষ্টা করলে ও দেখতে দেখতে সৰ্ব্বাঙ্গিনী হয়ে ওঠে। সাধারণত প্রেয়সীরা হৎকমলে স্থান গ্রহণ করে থাকেন কিন্তু শ্ৰীমতী ম্যালেরিয়া হচ্চেন যকৃৎবাসিনী, প্লীহাবিনোদিনী। কবিরা বলে থাকেন প্রেয়সীর আবির্ভাবে হৃদয়ে ঘন ঘন স্পন্দন উপজাত হয়, কিন্তু ম্যালেরিয়ার আবির্ভাবে সৰ্ব্বাঙ্গ মুহুর্মুহু স্পন্দিত হতে থাকে। অবশেষে অত্যন্ত তিক্ত উপায়ে তার বিচ্ছেদ ঘটাতে হয়। কিন্তু তার সঙ্গে একবার মিলন হলে বারে বারে সে ফিরে ফিরে আসে। তাই আমি করুণকণ্ঠে সানুনয়ে সকলকে অনুরোধ করে বলেছিলেম, “ভদ্রমহিলাগণ এবং ভদ্রলোক সকল, ধৰ্ম্মের নামে, দেশের নামে, সৰ্ব্বমানবের নামে আমি আপনাদের নিবেদন করচি, কদাচ আপনারা ম্যালেরিয়াকে প্রশ্রয় দেবেন না, আপনাদের প্লীহা ও যকৃতকে কদাচ তার চরণে উৎসর্গ করবেন না। আর যদি কখনো শোনেন মশা কানের কাছে মৃদুমন্দ গুঞ্জনধ্বনি করচে তবে তার সেই মায়ায় ভুলবেন না, যদি দেখেন সে আপনাদের চরণাশ্রয় গ্রহণ করেচে তবে নিৰ্ম্মমভাবে এক চপেটাঘাতে তাকে বিনাশ করতে কুষ্ঠিত হবেন না। উত্তিষ্ঠত, জাগ্রত, প্রাপ্য ডাক্তারাণ নিবোধত।"(চিঠিপত্র; অষ্টাদশ খণ্ড)

ম্যালেরিয়া ভাবিয়ে তোলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কেও। তাঁর লেখায় পাই, "সমগ্র সভ্যজগৎ ও জীবন হইতে দূরে একাস্তে যখন দলে দলে শ্বেতাঙ্গ চা-করেরা (planter) গিয়া আবাদ আরম্ভ করিল তখন শতকরা কতজন কালাজ্বর ম্যালেরিয়াতে মারা গেল ; ও অঞ্চলে গেলে কতশত ইংরেজের কবর দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু উদ্যম,ওদের এত অল্প বাধাতেই নষ্ট হয় না । তারা কুইনাইন খাইয়া মশা তাড়াইবার জন্য বাড়ীঘর লোহার জাল দিয়া ঘিরিয়া কাজ স্থরু করিল।" প্রফুল্লচন্দ্র আসলে ম্যালেরিয়া নিধনযজ্ঞে বাঙালিকে হাতেকলমে নামতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছিলেন। এই সময়টায় ১৯৫৫ সালে তাঁর ডাকেই বেঙ্গল কেমিক্যালে ম্যালেরিয়ার ওষুধ তৈরি করতে যোগ দেন চিকিৎসক কার্তিক বসু। আজ সেই ওষুধ নিয়েই গোটা বিশ্বে কাড়াকাড়ি।

কলেরার কথাই বা বাদ দিই কেন। জমিদারের কুয়োয় জল না পেয়ে গ্রাম বাংলা পুকুরের জলে মুখ দিয়েছে। কলেরা ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছে গ্রাম। শুধু ১৯৪৩ সালেই কলেরায় মারা গিয়েছেন বাংলার ২ লক্ষ ১৬ হাজার ৪২৮ জন মানুষ ।

শিল্পী চিত্তপ্রসাদের ছবিতে মারী-মড়কের দিনগুলি।

বাংলার গ্রাম গ্রামান্তরে যখন সংক্রমণ ছড়িয়েছে, কেউ হত্যা দিয়েছে ওলাবিবির থানে। কেউ মানত করেছে শীতলার কাছে। চিকিৎসাকেন্দ্রে সে যেতে চায়নি। অসুখ আর ব্যক্তিগত থাকেনি হয়ে গিয়েছে সামাজিক। দলাদলি ও ক্ষুদ্রস্বার্থ ভুলে নিরন্ন মানুষ একজোট হয়ে গিয়েছন ধর্মীয় সংস্কারের মঞ্চে। ব্রিটিশও দাঙ্গার ভয়ে দোমনা ছিল, দেখিয়েছেন ইতিহাসকার দীপেশ চক্রবর্তী। তবে চেষ্টা যে একেবারেই হয়নি তাও কিন্তু নয়।

'ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ হিস্ট্রি অফ সায়েন্স'-এ প্রকাশিত 'পপুলার রেসপন্স টু এপিডেমিক ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল' নিবন্ধে প্রকাশ- বাংলায় ১৮৬৭ সালে ইওরোপীয় চিকিৎসার ক্লিনিক ছিল ৬১টি। ১৯০০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০। অর্থাৎ দেবদেবতা যখন হার মেনে গিয়েছে, শত সহস্র মায়ের কোল যখন খালি হয়ে গিয়েছে তখন মানুষকে দ্বারস্থ হতে হয়েছে সেই বিজ্ঞানেরেই।

তথ্যের গলিখুঁজিতে ঘুরে চোখে ধাঁধাঁ লেগে যায় মনে প্রশ্ন জাগে। বাংলা উনিশ শতকে যে মৃত্যুমিছিল দেখেছে আজ ইওরোপ অ্যামেরিকাও তাইই দেখছে। আমাদের ঘরেও কি আতঙ্ক নেই? আছে। কিন্তু মাত্রা বিচার করলে, আর ইতিহাসটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই মনে হবে, আমরা পর্বত দেখে ফেলেছি। আর এই 'মুষিক'ই আজ শ্মশান করে দিচ্ছে পশ্চিমের দেশগুলিকে। কেন? যাঁরা উপনিবেশ গড়তে এসেছিল, সেই সুসভ্য জনজাতিই আজও নিজেদের দেশে জনস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করতে পারল না! আদৌ ধনতন্ত্রিক দেশ জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবেছে? আমাদের আর ভয় কী, মারী নিয়েই তো ঘর।

Published by:Arka Deb
First published:

Tags: Corona Virus