#বাহারেন: ২৪শ ফেব্রুয়ারি, ২০২০। দুম করে জীবনটা পাল্টে গেল! সেই পাল্টে যাওয়া জীবনের সঙ্গে এখনও বোঝাপড়া করে চলেছি!
নমস্কার! আমি, কৌশানী রায় সরকার! ৩বছরের ছেলে, স্বামী আর একটি পোষ্য নিয়ে বর্তমানে বাহরেনে থাকি। কোনও দিন এমন হয়েছে আপনার সঙ্গে? সমস্ত পরিকল্পনা আপনার মাথায় রয়েছে, পুরো ছক কষে রেখেছেন, আপনি জানেন (a+b)² এর মানে কী! তারপর হঠাৎ পরীক্ষা দিতে গিয়ে জানলেন আজ অঙ্ক নয়, ইতিহাস পরীক্ষা! সব এলোমেলো হয়ে গেল। আমার এমনটাই হল। যে মুহুর্তে একজন কোভিড-১৯ আছড়ে পড়ল, গোটা বাহরেন নিমেষে পাল্টে গেল! চারিদিকে যেন যুদ্ধকালীন তৎপরতা! কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব বন্ধ, রীতিমতো বন্দি আমরা! অথচ আমার জীবনে তখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে! এই ঝড়ের নাম করোনা নয়, প্রভিশনাল অটিজম!
অবশ্য এই ঝড় বইছে দেড় বছর আগে থেকেই! আমার ছেলে রোদ্দুর! ভালো নাম ঐরিক, ওর বিকাশজনিত কিছু সমস্যা রয়েছে! চিকিৎসা পরিভাষায় রোদ্দুর একজন নন ভার্বাল চাইল্ড! এই করো ওর স্কুল থেরাপি সব বন্ধ হয়ে গেল! এখন আমি ছেলেকে কী ভাবে ওর নিজের রাস্তায় রাখব সেই চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছি! এ দিকে দোকানপাট একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে খোলা থাকছে! এক সপ্তাহের মধ্যে লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমিতের নম্বরও বেড়ে চলেছে! এখন যখন লিখছি এই দেশটায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছুঁইছুঁই।
করোনা সংক্রমণ তখন শুরু হচ্ছে। একবার ভাবলাম, দেশে ফিরে যাই! কিন্তু তারপর আবার, ওই রোদ্দুরের কথা ভেবে থেকে গেলাম! নিজের লড়াইকে কখনও বড় করে দেখিনি! কিন্তু আজ য়খন দু'দিক থেকেই আক্রমণ আপনাদের সবার সঙ্গে এই সময়টা কে শেয়ার করে নিতে চাই। আমি জানি আমার মতো এমন অনেক অনেক মা বাবা রয়েছেন গোটা পৃথিবী জুড়ে আজ তাঁরা লড়াই করে যাচ্ছেন! একদিকে কোভিড-১৯. অন্য দিকে আমার প্রভিশনাল অটিস্টিক ছেলে! এ এক যুদ্ধই বটে।
পুরোটা সামাল দিয়ে গিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলছি! বার বার বোঝাচ্ছি নিজেকে, পেরিয়ে যাবে, এই সময়টাও পেরিয়ে যাবে, " this time shall pass too"! সামাজিক জীবন বলে আর কিছু নেই আর! যখন বাজার করতে যাই, মানুষের দেখা মেলা ভার! বাহরেনে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী রয়েছেন, আমাদের দেশের মতো। তাদের দোকানগুলি খুলছে! তবে বড় বড় মল গুলো সব বন্ধ! সিনেমা, জিম, স্কুল, কলেজ, সব রকমের সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ! সৌদি আরবের সঙ্গে জুড়ে থাকা কজওয়ে বন্ধ! কিন্তু তারিফ না করে পারছি না এখানকার রাজার! তিনমাসের জন্য জল, বিদ্যুৎ সব ফ্রি করে দিয়েছেন! শুধু স্থানীয় নয়, বহিরাগতদেরও বাড়িভাড়া দিতে হবে না আগামা তিনমাস! বয়স্ক এবং অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদেরও জন্যেও বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়ছে।
তবে সারা পৃথিবীর দিনমজুরদের ছবিটাই বোধহয় এক। এখানেও তাদের অবস্থা বাজেই! অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, ফলে সবার আগে ওঁরাই আহত! অনেকে নিজের চাকরি হারাচ্ছেন! এমন অনেক অভিবাসীকে আমি চিনি যাদের চাকরি না থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরতে পারছেন না! অনেক ফিলিপিনো, বাংলাদেশি, নাইজেরিয়ান আটকে গেছে! পরিবহণ নেই বলেই দেশে ফিরতে পারছেন না।
বাহরেনের পরিকাঠামো অন্যান্য গলফ কর্পোরেশান দেশগুলোর তুলনায় কিন্তু যথেষ্ট দূর্বল! অথচ, বাহরেন এখনও সব থেকে নিরাপদ জায়গা বলে আমার মনে হয়। কারণ এখানকার মানুষ সহানুভূতিশীল! সাহায্য করেন! রাজা যা যা বলছেন, তাঁর সব কথা লক্ষ্মী ছেলেমেয়ের মতো শুনছে! কোন উপরচালাকি নেই! তাই হয়তো, বাহরেন খুব সুন্দর করে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে সংক্রমণ।
আশার কথা বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকার পরে রোদ্দুরের থেরাপি সেন্টারটা খুলেছে! ছেলেকে নিয়ে ওখানে যাই রোজ। প্রতিটা জায়গায় খুব নিয়ম কানুন মেনে চলা হয়! এখানে আলাদা করে লক্ষ্মণরেখা কাটতে হয় না, মানুষ এমনিই দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করছে! আস্তে আস্তে জনজীবন স্বাভাবিক হচ্ছে! নাহ! তবে ভাববেন না আগের মত! সেটা হতে এখনো ঢের বাকি! এদিকে সৌদি, ওদিকে ইউএই, আর এক পাশে ইরান! আমরা কেউ-ই সেপ্টেম্বরের আগে কিছু আশা রাখছি না!
লেখক পরিচিতি- কৌশানী রায় সরকার বাংলা টেলিভিশনের চেনা মুখ। এখানে আকাশ নীল নামের জনপ্রিয় ধারাবাহিকে তাঁর অভিনয় দর্শকদের মন কেড়েছিল। 'কাদের কুলের বউ', 'অভিশপ্ত নাইটি' ইত্যাদি সিনেমাতেও অভিনয় করছেন কৌশানি। সম্প্রতি তিনি বাহারেনে থাকেন।
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Corona Virus