#হাওড়া: বেলা তখন ৩টে । হাওড়া স্টেশনের বাইরে শুনশান। রেল পুলিশ ছাড়া আর কেউ নেই। একদিকে কিছু ভবঘুরে বসে রয়েছে। যখনই কোন গাড়ি আসে, ভবঘুরেরা গাড়ির দিকে ছুটে যাচ্ছে যদি কেউ খাবার দেয় ৷ কিন্তু এর মধ্যেই দেখা গেল অন্য এক দৃশ্য ৷ একটি ট্রলি ব্যাগ টেনে নিয়ে এপাশ থেকে ওপাশ হেঁটে বেড়াচ্ছেন এক ব্যক্তি। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ রয়েছে। কথা বলে দেখা গেল, লোকটি পাগল কিম্বা ভবঘুরে নয়। বেড়াতে এসেছিলেন কলকাতায় কিন্তু আর ফিরতে পারেননি। কমলাকার তুলসীরাম (৬৩)। ইনি দু’মাস আগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থক্ষেত্রে তীর্থ করতে বেরিয়েছিলেন। গত ২০ তারিখ বেনারস থেকে ট্রেনে চেপে হাওড়া এসে পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে কালীঘাট। ২২শে মার্চ সারাদিনের জন্য জনতা কার্ফু ছিল ভারতবর্ষ। ২৩তারিখ আচমকাই সরকার সারাদেশ ২১ দিনের জন্য লকডাউন করে দেয়।
কমলাকার আর নিজের বাড়িতে ফিরতে পারেননি। এই কমলাকারের বাড়ি মহারাষ্ট্রের নাসিকের, দত্ত চকে। বাড়িতে মা, বোন ,ভাগনা এবং ভগ্নিপতি রয়েছে। উনি নাসিকে টাকশালে চাকরি করতেন। ৩ বছর আগে চাকরি থেকে অবসর নেন। তারপর থেকেই মাঝে মাঝে বিভিন্ন তীর্থস্থানে ঘুরে বেড়ান। এবার তিনি আর বুঝতে পারেননি এই লগডাউনে আটকে পড়বেন কলকাতায়।
২০শে মার্চ হাওড়ার একটি হোটেলে এসে উঠেছিলেন। করোনার সংক্রমনের ফলে এবং লকডাউনের জন্য ২৪ তারিখ সকাল বেলা ওকে হোটেল থেকে হোটেল কর্তৃপক্ষ বের করে দেন। তারপর অনেকবার বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান গুরুদুয়ারা সব জায়গাতে আশ্রয়ের জন্য গিয়েছিলেন। কিন্তু এই বৃদ্ধ কোথাও থাকার অনুমতি পাননি। হাওড়া স্টেশনের সামনে অপেক্ষা করা কিম্বা ঘুমানো বারণ। রাতেবেলা স্টেশনের বাস স্ট্যান্ডের দিকে যখন ঘুমোনোর জন্য যাচ্ছেন, তখন চোরেদের উৎপাত। কথা বলতে বলতে দেখালেন ট্রলি ব্যাগটা ব্লেড দিয়ে বেশ কয়েকটা যায়গায় কেটেছে চোরেরা। ঘুমোতে গেলে কেউ না কেউ কিল চড় চাপড় মেরে যাচ্ছে। বেগতিক ওই টুকু জায়গার মধ্যে সারাদিন ঘোরাফেরা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
২০ দিনের ওপর একইভাবে কাটিয়ে যাচ্ছেন উনি।কখনও কখনও পুলিশ কিংবা কোন সংস্থা থেকে যা খাবার দিয়ে যায় সেটাই খেয়ে খিদে নিবারণ করছেন।ফুটপাথের ভিক্ষুকদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার খাচ্ছেন। হাওড়া রেল পুলিশের কাছে বহুবার অনুরোধ করেও,এই অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরে- কোনভাবে মাথাগোঁজার ঠাঁই কোথাও পায়নি। রেল পুলিশের বক্তব্য, যখন সরকার থেকে স্টেশনের বাইরে বসে থাকা বিভিন্ন জায়গার লোকজনকে বাসে করে তাদের বাড়ি,পাঠানো হয়েছিল তখন উনি ছিলেন না। কমলাকার বাবু জানান, উনি বাংলা বোঝেন না, রাস্তাঘাট চেনেন না। অনেক বার অনুরোধ করেছিলেন অনেককে কিন্তু ওর কথা কোন ভাবে গুরুত্ব দেয়নি কেউ। প্রশ্ন, লকডাউন হয়েছে বলে ভিন রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ এই বাংলায় মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে না? করোনা সংক্রমনের আতঙ্কে সবাই মানবিকতা হারিয়েছে? শুধুই কমলাকার নয় ,শিয়ালদহ স্টেশনের বাইরে বেশ কয়েকজন শ্রমিক ফুটপাতে শুয়ে রয়েছেন। মাঝে মাঝে পুলিশের গণ মার কিংবা চোরেদের উৎপাত ।সে সব সহ্য করে ,যে যা দেয় তাই খেয়ে ফুটপাতে শুয়ে দিন কাটাছেন।
অনেকেরই প্রশ্ন ঘণ্টা বাজানো প্রদীপ জ্বালানো, এটা যদি রীতি হয় ।তাহলে এই লোকগুলো কী দোষ করেছিল ? নিজের বাড়িতে গিয়ে কিংবা কোনো ছাদের তলায়, আলো নিভিয়ে প্রদীপ জ্বালাতে পারলেন না! করোনা ভাইরাসে এদের মৃত্যু নয়, মৃত্যু হবে হয়তো ফুটপাতের নোংরায় শুয়ে, আজানা কোন রোগে! লকডাউন যদি আরও দীর্ঘ হয় তাহলে কমলাকার কিংবা আর যারা ফুটপাথে শুয়ে, ১৫ ই এপ্রিল এর জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা কি করবেন? সরকার কী একবারও ভেবেছে এদের জন্য?
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Corona Virus, COVID-19, Lockdown